বাংলা অন্যতম কথা সাহিত্যিক শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় তার কালজয়ী উপন্যাস শ্রীকান্তে লিখেছেন —- মাঠে বাঙালি ও মুসলমান ছেলেদের মধ্যে ফুটবল ম্যাচ, সে খেলা চলাকালীন সময়ে বাঙালি ও মুসলমানদের মধ্যে মারামারি লেগে যায়, এতে উপন্যাসের নায়ক শ্রীকান্তের পিঠে দুই চার ঘা পরতেই সে দৌড়ে পালাতে গিয়ে ইন্দ্রের দেখা পেল। শরৎ বাবুর শ্রীকান্ত উপন্যাস নিয়ে আলোচনা করা আমার মুখ্য উদ্দেশ্য নয়। শরৎ বাবুর একটা উক্তি সকাল বেলার সেই শিশিরবিন্দু, যার মধ্যে বিশাল মহাকাশের প্রতিচ্ছবি ভেসে ওঠে। বিষয়টিকে হালকা করে নেওয়ার কোন উপায় নেই কারণ শরৎ বাবু শুধু কথা সাহিত্যিক ছিলেন না, অন্যতম রাজনৈতিক ব্যাক্তিত্ব ছিলেন। ১৯২১ থেকে ১৯৩৬ খ্রীস্টাব্দ পর্যন্ত একটানা দীর্ঘ ১৬ বছর তিনি জেলা কংগ্রেসের সভাপতি ও নির্বাচিত জনপ্রতিনিধি ছিলেন। এমন একজন সাহিত্যিক ও রাজনীতিবিদের উক্তি অবশ্যই গুরুত্বপূর্ণ।
প্রশ্ন আসে কেন বাংলার মুসলিমদেরকে বাঙালি মনে করা হতো না। বিষয়টি অত্যন্ত পরিষ্কার, ১৭৫৭ সালে বাংলার স্বাধীনতার সূর্য অস্তমিত যাওয়ার পর এ উপমহাদেশ সাম্প্রদায়িক বিষবাষ্পের বীজ রোপিত হয়। তারপরও কিন্তু সামাজিক নেতৃত্বে মুসলিমরাই এগিয়েছিল। মূলত এ কারণেই দেখা যায় ১৭৮০ সালে খ্রিস্টান ধর্মালম্বী ইংরেজ কলকাতা আলিয়া মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠা করে মুসলিমদের ধর্মীয় শিক্ষার প্রসার করেছিল। এটাই ছিল বাহ্যিক দিক, আর আভ্যন্তরীন দৃষ্টিভঙ্গি ছিল মুসলিমরা শিক্ষা দীক্ষা, প্রশাসনিক দক্ষতা, সাংগঠনিক শৃঙ্খলা, নেতৃত্বের গুণাবলী, শৌর্যবীর্যের অধিকারী। তাই মুসলিমদেরকে পরাজিত ও নতজানু করার জন্য তাদের শিক্ষা ব্যবস্থাকে পরিবর্তন করে দিতে হবে, এমন মেরুদণ্ডহীন শিক্ষা প্রণয়ন করতে হবে যেটা লাভ করে তারা আর কোনদিনই সোজা হয়ে দাঁড়াতে না পারে। তাই হয়েছিল, ১৮৩০ সালে কলকাতায় ছাপাখানা প্রতিষ্ঠা হওয়ার পর যেসব বাংলা সাহিত্য বা পাঠ্যপুস্তক রচনা করা হয় সেসবে মুসলিম শাসনকে অবজ্ঞা ও হেয় প্রতিপন্ন করা হয়। কিন্তু তৎকালীন শিক্ষিত মুসলিমরা এর কোন প্রতিবাদ বা প্রতিকার করতে পারেনি। পরবর্তীতে ভারতীয় উপমহাদেশে মুসলিম শাসনের প্রচন্ড সমালোচনা করা হয়, মুসলিমদের সুশাসনকে বিকৃত করে সাম্প্রতিকতার প্রলেপ লাগানো হয়। মুসলিম শাসক ও নবাবদের চরিত্র হনন করা হয়, এমনকি তাদের অন্দরমহলের উপরও কালিমা লিপ্ত করার অপপ্রচার চালানো হয়। অপরদিকে হিন্দু জাতিকে শৌর্যবীর্য মহামান্বিত রাজপুরুষ হিসেবে সাহিত্যে গল্পে উপন্যাসে স্থান দেওয়া হয়।
সাহিত্যে পাঠ্যপুস্তকে মুসলিম জাতির পরিচিতি হয় অধঃপতিত, মূর্খ জনগোষ্ঠী, ভূমিহীন কৃষক, দিনমজুর, তাঁতি ও জোলা হিসেবে। বঙ্কিমচন্দ্র থেকে শরৎচন্দ্র পর্যন্ত সকল হিন্দু সাহিত্যিকগন মুসলিম জাতিকে হেয়প্রতিপন্ন করে, অসহায় নপূংসক বানিয়ে বিভিন্ন সাহিত্য রচনা করেন, ছোটগল্প “মহেশ” তার একটি উদাহরণ। মুসলিমদের অচ্ছ্যুৎ, নেঁড়ে, যবন বলে সম্বোধন করে সামাজিকভাবেও বয়কট করে চলা হতো। এ কারণে প্রবাদ ছিল– “পড়েছি যবনের হাতে, খানা খেতে হবে একসাথে” । অর্থাৎ মুসলিমদের সাথে পাশাপাশি বসে খানা খেতে, একই নৌকায় উঠে পারাপার হতেও তাদের আপত্তি ছিল। এমনকি তাদের সম্ভ্রান্ত কুলীন বাড়ির পাশ দিয়ে মুসলিমদের ছাতা মাথায় এবং জুতা পায়ে হেঁটে চলার অনুমতিও ছিল না। এ কারণে উনবিংশ শতাব্দি থেকে বিংশ শতাব্দীর প্রথমার্ধ পর্যন্ত বাংলার মুসলিমদেরকে বাঙ্গালী মনে করা হতো না। আর বাংলার মুসলিমরাও বাঙালি সংস্কৃতি ও কৃষ্টি কালচার থেকে নিজেদেরকে দূরে সরিয়ে রাখতে। তাইতো শরৎ বাবু লিখেছিলেন বাঙালি ও মুসলমান ছেলেদের মধ্যে ফুটবল ম্যাচ।
হিন্দুজমিদার ও মাড়ওয়ারীর জুলুম শোষণে অতিষ্ঠ হয়ে বাংলার মুসলিমরা যখন পশ্চিমবাংলার বাঙালিদের পরিবর্তে হাজার মাইল দূরের মুসলিম জনগোষ্ঠীর সাথে হাত মিলিয়ে মুসলিমদের স্বাধীন আবাস ভূমির দাবি উত্থাপন করে, ঠিক তখন থেকেই পশ্চিমবাংলার বাঙালি জনগোষ্ঠীর পিলে চমকে যায়। তখন তারা সুর পাল্টে বলতে থাকে ভারতের হিন্দু মুসলিম সকলে মিলে এক জাতি, হিন্দু মুসলিম ভাই ভাই ইত্যাদি ইত্যাদি। মুসলিমরা স্বাধীন আবাসভূমি লাভ করলে তাদের অন্তর জ্বালা বেড়ে যায়,ওদেরকে আর আগের মত অচ্ছ্যুৎ নেড়ে যবন বলা যাবে না, জুলুম শোষণ চালিয়ে কাঙ্গাল ভিখারিতে পরিনত করে, কলকাতা বাবুদের আয়েসি জীবন যাপন সম্ভব হবেনা।
জোটবদ্ধ মুসলিমদের সাথে শক্তিতে না পেরে তারা ক্ষুব্ধ হয়ে দুধের স্বাদ ঘোলে মিটানোর জন্য মুসলিমদের সাংস্কৃতি এবং ঐতিহ্যের উপর আগ্রাসন চালায়। পত্রপত্রিকা, সাহিত্য কিংবা উপন্যাসে বাঙালি ও মুসলমান ছেলেদের মধ্যে ফুটবল ম্যাচ এমন বিভেদের কথা বলা বন্ধ করে। মুসলমানকে বাঙালি বানাতে তারা উঠে পরে লেগে যায়। মোরা বাংলা মায়ের সন্তান, মায়ের চরণ মলিন হয়েছে , এসো বাঙালি হিন্দু ও মুসলমান ভাই ভাই একত্রে পরিষ্কার করি। একত্রে খেলে আর জাত যায় না, কারণ মুসলমানেরা এখন জুতা পায়ে দবদবিয়ে বাঙ্গালী উঠোন দিয়ে চলাফেরা করে। এখন বাঙালি ও মুসলমান আলাদ করে লাভ নেই, কারণ স্বাধীন মুসলিম দেশে বাঙালিরা সংখ্যালঘু ও নতজানু হয়ে পড়ছে। তারা বাধ্য হয়েই স্বীকার করে নিল বাংলাভাষী হিন্দু-মুসলিম সকলে মিলেই বাঙালি। মুসলমানদেরকে সাথে নিয়েই বাংলাদেশে বাঙালির অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখা সম্ভব। না হলে সবাই তো একদিন বাংলাদেশী হয়ে যাবে।।
এসব কারণেই তারা সাংস্কৃতি ও প্রগতির কথা বলে ইসলামী কৃষ্টি-কালচারে পৌত্তলিকতার প্রলেপ দেওয়া শুরু করে। ভাষা আন্দোলন থেকে শুরু করে রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক অঙ্গনে, প্রভাত ফেরী, বর্ষবরণ, বটতলায় ছায়ানট ও মঙ্গল শোভাযাত্রা এসব কিছুই পৈত্তলিক সংস্কৃতির অংশবিশেষ। আমাদের পূর্বপুরুষদেরকে যারা অচ্ছ্যূৎ, নেঁড়ে ,যবন বলে একত্রে নৌকায় উঠেনি, এক মজলিসে খানা খায়নি, তাদেরই বর্তমান প্রজন্মকে পরম হিতাকাঙ্খী মনে করছি, তাদের সংস্কৃতি কৃষ্টি-কালচার অবলীলায় গ্রহণ করছি। যা দিয়েছি এবং যা নিতেছি তা কেউ ভুলবে না, চিরকাল মনে রাখার মত।
তাইতো বাংলাদেশের মুসলিমদেরকে দ্বীন ইসলামের অনুসারী না ভেবে বাঙালি সংস্কৃতির অনুসারী ভাবাটাই যুক্তিসঙ্গত। সেভাবেই আমাদের পাঠ্যপুস্তকে, কলেজ ইউনিভার্সিটির ছেলেমেয়েদের মোটিভেশন করা হচ্ছে। সবার উপর বাঙালি সংস্কৃতি তার উপর নেই, এ বিশ্বাসে বাংলার মুসলিমরা বাঙালি সেজেছে, এ নীতি মেনে নিয়েই বাঙালি মুসলমানরা এগিয়ে যাচ্ছে।
শেরওয়ানি পরিহিত মুসলিমরা ব্রিটিশ শাসনামলে নেংটি পরা মুসলমান হয়েছিল, মাঝখানে অর্ধশতাব্দী শেরওয়ানি টুপি পাগড়ী নিয়ে বীরত্বের সাথে বুক উঁচু করে চলাফেরা করলেও বর্তমানকালে বাঙালি মুসলিমরা যে নৌকায় সওয়ার হয়েছে তাতে বোঝা যাচ্ছে আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্ম হয়তোবা পুনরায় নেংটি পরা মুসলমান রূপে বাঙ্গালী ছেলেদের সাথে ফুটবল ম্যাচে প্রতিযোগিতা করবে।
এ কারণেই মুসলিম শাসকের প্রবর্তিত বাংলার ফসলী সনের মালিক মোক্তার হয়ে গেল বাঙালিহিন্দুরা, বাঙালি কৃষ্টি কালচার মঙ্গল শোভাযাত্রার হুতুম প্যাঁচার চোখ রাঙ্গানিতে ইসলামী তাহজিব তামাদ্দুন সত্যি সত্যি কোণঠাস হয়ে পড়ল। ইসলামপন্থীরা সারা বছর দাওয়াতি কাজ করে যতটুকু ইসলামী পরিবেশ, ভাবধারা সৃষ্টি করছে পহেলা বৈশাখের মঙ্গল শোভাযাত্রা সোলায়মান নবীর বোয়াল মাছের মতো এক লোকমায় শেষ করে দিচ্ছে।
কারণ দ্বীন ইসলাম নিজস্ব তাহাজীব তামাদ্দুন ব্যতীত স্থায়ী রূপ লাভ করতে পারে না। এজন্য ইসলামী তাহজিব তামাদ্দুনের বিরুদ্ধে কলকাটি নাড়ছে। মোল্লারা তো আযান দিয়ে খেতে অভ্যস্ত, বাঙালি মুসলিমদের তাহজীব তামাদ্দুন নিয়ে আকাবীরগণের কোন মাথা ব্যাথা নেই, নিজেদের পদ-পদবী ও আরাম আয়েশ পেলেই হলো। তাইতো তারা যাদের মদদে আরাম-আয়েশি জীবন যাপন করে, সেসব প্রভুর মনঃসন্তুষ্টির জন্য ইসলামী তাহজীব তামাদ্দুনের প্রচলন ও প্রতিষ্ঠা যারা করতে চায় তাদের বিরুদ্ধে ফতোয়া দেওয়াকে নৈতিক দায়িত্ব মনে করে।
একটা কথা আছে কোন জাতিকে ধ্বংস করার জন্য সে জাতি সব সদস্যকে হত্যা করার প্রয়োজন নেই, কোন জাতির কৃষ্টি কালচার পরিবর্তন করে দিতে পারলেই সে জাতি আপনা আপনি ধ্বংস হয়ে যাবে। মুসলিমরা বাঙালি পরিচয় গ্রহণ করেছে, হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালির পদ পেয়েছে, এতে কোন লাভ নেই। এদেশ থেকে মুসলিম কৃষ্টি কালচার সমূলে ধ্বংস করে পৌত্তলিক সংস্কৃতির প্রচার, প্রচলন ও প্রতিষ্ঠা করতে পারলেই এই নেঁড়ে মুসলমানরা প্রকৃতপক্ষেই বাঙালি হয়ে উঠবে। তাইতো তারা বলে –“বিশ্ব মানব হবে যদি কায়মনে বাঙালি হও”
হায় আফসোস, ফররুখের জামানা শেষ হয়ে গেছে, পাঞ্জেরী কোথায় যেন হারিয়ে গেল। তিমির রজনীতে উত্তাল সাগরে যাঁরা জাহাজ ভাসিয়েছিল তাঁদেরই বংশধরেরা আজ মঙ্গল শোভাযাত্রার প্রস্তুতি নিচ্ছে, বাঙালি মুসলিমরা আজ শরৎ বাবুর মুসলমানে পরিণত হয়ে যাচ্ছে।
ইবনে শাহ