পিতা মাতার পরে সবচেয়ে বেশি আপন ভাবে যাদেরকে আমরা পেয়েছি তারা হলেন মামা চাচা ফুফু খালাদের। বাবা-মায়ের আদর সোহাগের পাশাপাশি শাসন থাকতো। কিন্তু মামা চাচা খালা ফুপুদের কাছ থেকে শুধুই আদর সোহাগ স্নেহ মমতা পেয়েছি। এদের কাছ থেকে কোনো দিন বকা খেয়েছি এমনটা মনে করতেই পারি না। এমনিভাবে নিজের ভাই বোনদের চেয়ে চাচাতো মামাতো ফুফাতো খালাতো ভাই-বোনদের কাছে মনে হয় বেশি আদর পেয়েছি। নিজের ভাই বোনদের সাথে এটা সেটা নিজে বকাঝকা খেলেও চাচাতো মামাতো ফুপাতো খালাতো ভাই বোনদের কাছে ছিল সাত খুন মাফ। এরা আমাদের কি পরিমাণ আদর সোহাগ দিয়েছে সেটা এখন বলে বোঝানো যাবে না। সে সব মধুর স্মৃতি আজও মনকে বিচলিত করে তোলে। প্রযুক্তির কল্যাণে আজ আমরা অনেক দূর পথ চলে এসেছি কিন্তু পিছনে ফেলে এসেছি সে সকল মধুর স্মৃতি, যা সমাজ থেকে আজ হারিয়ে যেতে বসেছে।
ছোটবেলা থেকে এখনো মাঝে মাঝে ভাবি,, সম্বন্ধের ক্ষেত্রে ইংরেজ জাতি এত কৃপণ কেন। মামা চাচা ফুফা খালু এই চারটি মধুর সম্পর্ককে তারা একটি করে ফেলেছে। এক আংকেল এ সব শেষ। তেমনি ভাবে মামাতো ফুফাতো খালাতো চাচাতো ভাই-বোনদেরকে এতিম করে একটিমাত্র সম্পর্কে টেনে নামিয়েছে তা হলো কাজিন। মাঝে মাঝে ভাবি ওদের ভাষায় কি শব্দের অভাব নাকি পরিবারে লোকের অভাব। কিন্তু জ্ঞান হওয়ার অর্ধশতাব্দী পেরিয়ে আজ কেন জানি বুঝতে পারলাম সত্যি সত্যি তাদের পরিবারের লোকের অভাবে আলাদা আলাদা শব্দের প্রচলন করা হয়নি।। যেমনটা আজকে আমাদের ছেলেমেয়েরা ঊপভোগ করছে। আমাদের নাতি নাতিরা হয়তো আরো বেশি কৃপণ হয়ে যাবে। আমাদের পরিবারগুলোতে সম্পদের প্রাচুর্যের সাথে সাথে পারিবারিক বন্ধন ও সম্পর্কের যে প্রাচুর্য ছিল, আমাদের পরবর্তী প্রজন্ম বিশেষ করে নাতি-নাতনিদের বেলায় সম্পর্কের কৃপণতায় বাংলার শব্দভাণ্ডার সংকুচিত হয়ে ইংরেজদের এক শব্দে পরিণত হয়ে যাবে। আমাদের নাতি নাতিরাও একদিন চাচা মামা ফুফা খালুর পরিবর্তে একটি শব্দেই প্রকাশ করবে। কারণ বাস্তবেই তাদের পরিবারে ওই চারটি সম্পর্কের লোক থাকবে না। তখন তারা বাধ্য হয়ে দুধের স্বাদ ঘোলে মিটানোর জন্য চারটি শব্দের পরিবর্তে একটি শব্দ আঙ্কেল ব্যবহার করবে।
তেমনিভাবে আজ আমাদের ছেলেমেয়েরা যেমন মামাতো ফুফাতো চাচাতো খালাতো ভাই-বোনদের আদর সোহাগ স্নেহের পরশে বেড়ে উঠতে পারছে না, আমাদের নাতি নাতিদের সময় হয়তো এই চারটি সম্পর্কের ভাই-বোনদের খুঁজে পাওয়া যাবে না। মামা চাচাদের কাঁধে উঠে মাইলের পর মাইল পথ চলেছি, এমন কোন আবদার ছিল না মামা চাচারা যেটা পূরণ করে দেয়নি। ফুফাতো খালাতো ভাই বোনেরা মামাবাড়িতে দল বেধে কি যে হইচই। এক ঘরে গাদা গাদি করে শোয়া, একত্রে বসে খাওয়া, খেলাধুলা, গাছ থেকে পাকা আম, কালো জাম পেড়ে খাওয়া, এসব বিষয় কি বলে বুঝানো যায়। এমনও হতে পারে মামাতো ফুফাতো খালাত চাচাতো ভাই বোন কেমন জিনিস এটা আমাদের নাতি-নাতিদেরকে বোঝানো যাবে না। কিংবা এসব দেখার জন্য, বুঝানোর জন্য তাদেরকে জাদুঘরে নিয়ে যেতে হবে। তখন হয়তো মামাতো ফুফাতো চাচাতো খালাতো ভাই বোনদের প্রতিচ্ছবি জাদুঘরে স্থাপন করতে হবে।
আজ হয়তো অনেকেই আমার সাথে একমত হবেন না। কিন্তু একটু খেয়াল করে দেখুন আজ আমাদের প্রতিটি পরিবারে ছেলে মেয়েদের সংখ্যা কেমন। কারো একটি মেয়ে কারো বা একটি মাত্র ছেলে। কারো বা দুই ছেলে মেয়ে। তাহলে যে সকল পরিবারে একটি মাত্র ছেলে বা একটি মাত্র মেয়ে আছে, সে সকল পরিবারের ছেলেমেয়েদের বিবাহ হলে ওই দুই পরিবারের নাতি-নাতিরা মামাতো ফুফাতো চাচাতো খালাতো ভাই বোনদের যেমন পাচ্ছে না তেমনি মামা চাচা ফুফু খালার আদর সোহাগ থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। যাদের দুটি বা তিনটি ছেলে-মেয়ে আছে তাদের নাতি নাতিরা কেউ মামা পাবে না, কেউ চাচা পাবে না। আবার কেউ কেউ ফুফু খালা পাবে না। এভাবেই আমাদের পরিবারগুলো থেকে মধুর সম্পর্কের চাচা মামা ফুফু খালা হারিয়ে যাচ্ছে, এ বিষয়ে কয়জনে খেয়াল করে।
এমনিতেই আমাদের ছেলেমেয়েদের শৈশবকাল হারিয়ে গেছে। তারা আমাদের মত বন-বাঁদরে ঘোরেনি, হাডুডু কানামাছি গোল্লাছুট খেলেনি, নদ নদীতে সাঁতার কাটেনি। তাদেরকে সুইমিংপুলে টাকা দিয়ে সাঁতার শিখাতে হচ্ছে। তারা সারাক্ষণ স্কুল কলেজ, কোচিং সেন্টার, টিউটর, কম্পিউটার নিয়ে বসে আছে। শৈশবকাল কিংবা ছেলেবেলা কি জিনিস তারা সেটা বুঝতেই পারল না। আমাদের ছেলেমেয়েদের যখন এই অবস্থা, তখন নাতিরা কেমন থাকবে এসব ভাবতে গা শিউরে ওঠে। নদীমাতৃক এদেশের ছেলে-মেয়েদেরকে টাকা দিয়ে সাঁতার শেখাতে হবে, আমরা কি এটা ছেলেবেলায় ভাবতে পেরেছিলাম? না, এমনটা হবে আমরা কোনদিনই ভাবি নি। কিন্তু এখন যখন হয়ে গেছে, এখন কি করতে হবে তাও ভাবতেছি না। আধুনিকতার নামে, প্রগতির নামে, জনসংখ্যার বিস্ফোরণ ঠেকাতে গিয়ে আমরা ছোট হতে হতে, বামুন হয়ে গেলাম। যৌথ পরিবার তো কবেই গেছে, আমাদের মাঝে আর আট দশটা ছেলে মেয়ের পিতা মাতা নেই। এক দুটিতেই কেল্লা খতম। তাহলে মামা চাচা ফুফু খালা কোথা থেকে আসবে। যে কারণে ইংরেজরা আংকেল এবং কাজিন শব্দ ব্যবহার করে পরিবারসমূহকে ছোট করে ফেলেছে। আমরাও আজ পাশ্চাত্যের প্রগতিশীল সাজতে গিয়ে নিজেদের লেজ ছেঁটে ফেলতে ফেলতে অতি প্রগতিশীলের কাতারে ওঠার চেষ্টা করছি। এভাবেই আমাদের পরবর্তী প্রজন্ম রোবটের মত আচরণ করা শুরু করবে। পরিবার ও পারিবারিক বন্ধন থাকবেনা, বেবি কেয়ার সেন্টার চাচা মামা ফুফু খালার জায়গা দখল করবে। ওল্ড হোম বা বৃদ্ধাশ্রম হবে তাদের নিরাপদ ও শেষ ঠিকানা।