পৃথিবীতে যত প্রাণী আছে,তামাম প্রাণীকুলের কাছে মাতৃভক্তি কথাটি খুবই সুপরিচিত। কারণ একটা সময় সকল প্রাণীকুল মাতৃ কোল ছাড়া কিংবা মায়ের স্নেহ মমতার পরশ ছাড়া পৃথিবীর পরিবেশে খাপ খেতে পারে না। পৃথিবীর পরিবেশে বেঁচে থাকার মত শক্তি সামর্থ জোগাতে মায়ের বিকল্প নেই। জন্ম যেভাবেই হোক প্রসব কিংবা ডিম থেকে, মায়ের কোলে কিংবা মায়ের সৃষ্ট তত্ত্বাবধানে বড় হতে হয় । পৃথিবীর সকল প্রাণীকুলের জন্ম মায়ের উদর থেকেই হয়ে থাকে। তাই মাতৃভক্তি পৃথিবীর মানুষের নিকট একটি অতি স্পর্শকাতর শব্দ। এ শব্দের কোন তুলনা হয় না, কোন মূল্য দিয়ে এ শব্দের পরিমাপ যাচাই করা যায় না। কিন্তু পৃথিবীর অন্যান্য প্রাণীদের পরিনত বয়সে একটা সময় পরে মা-বোনের সম্পর্ক কিংবা মাতৃভক্তির চেতনা লোপ পেয়ে যায়। শুধুমাত্র মানুষের বেলায় এটা হয় না, তাই তো আমরা সর্বশ্রেষ্ঠ প্রাণির মর্যাদা পেয়েছি। কিন্তু ইদানিং আমাদের দেশে কিছু স্বনামধন্য বঙ্গমাতার সন্তানদের জন্য সর্বশ্রেষ্ঠ প্রাণীর মর্যাদা রক্ষা করা দুষ্কর হয়ে যাচ্ছে।
বঙ্গ মাতার অবোধ সন্তান যাদের বিদ্যাবুদ্ধি ধনসম্পত্তি প্রভাব-প্রতিপত্তি একেবারেই নগণ্য তারা কিন্তু মায়ের মর্যাদা যথাযথভাবে পালন করছে। সমস্যা হচ্ছে জাতি যাদেরকে শপথের মাধ্যমে মায়ের মর্যাদা রক্ষার দায়িত্ব দিয়েছে, তাদের মাধ্যমেই বঙ্গমাতার ইজ্জতহানী হচ্ছে সবচেয়ে বেশি। তাও আবার গোপনে নয়, বঙ্গ- মাতার শত শত উচ্চশিক্ষিত ক্ষমতাধর সন্তানের সামনে। দুঃখের বিষয় হল যারা দেশপ্রেমকে মাতৃভক্তির সাথে তুলনা করেছে তারাই আজ দেশমাতৃকার চরম ইজ্জতহানীর কারণ হচ্ছে। দেশমাতার অধিকার হরণ হচ্ছে, মর্যাদার হানি হচ্ছে সর্বশেষ ইজ্জতটুকু চরমভাবে লংঘিত হচ্ছে দেখে- শুনেও তাঁর যোগ্য বীর সন্তানরা একে অপরের মুখ পানে চেয়ে নপুংসকের মত চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছে । শুধু তাই নয় দেশমাতৃকার সার্বভৌমত্ব, অধিকার, ইজ্জত আব্রু রক্ষার জন্য যে জৈষ্ঠ ভ্রাতারা জান-প্রাণ কোরবান করত, তাদেরকে দুর্বল করার শত প্রচেষ্টা চালিয়েছে, এমনকি হত্যা করে ফেলেছে। দেশমাতৃকার ইজ্জত লুণ্ঠনকারীদের দয়া ও দানে সেসব খুনি হাইজ্যাকার আজ সর্বশেষ্ঠ দেশপ্রেমিক।
বিগত কয়েক দশক ধরে আমাদের দেশপ্রেমকে মাতৃভক্তির সহিত তুলনা করা হচ্ছে। দেশের স্বাধীনতা সার্বভৌমত্বকে মাতৃভূমি কিংবা মাতৃত্বের রক্ষা বলে মূল্যায়ন করা হচ্ছে। দেশের প্রতি ভক্তি শ্রদ্ধাকে মাতৃভক্তি হিসেবে সম্মোধন সর্বপ্রথম আমাদের এই বঙ্গদেশে শুরু হয় ১৯০৫ সালে। ১৯০৫ সালে ব্রিটিশ ভারতে আয়তন এবং জনসংখ্যা দিক থেকে সর্ববৃহৎ প্রদেশ ছিল বেঙ্গল প্রভিন্সী। সেই উড়িষ্যার উপকূলে থেকে শুরু করে চট্টগ্রামের কক্সবাজার পর্যন্ত ছিল বেঙ্গল প্রভিন্সীর সীমানা। রাজধানী ছিল কলকাতা। নদী বিধৌত পূর্ব বাংলার যাতায়াত ব্যবস্থা ছিল অত্যন্ত নাজুক। কলকাতায় বসে পূর্ব বাংলার প্রশাসনিক কাজ সামাজিক উন্নয়ন কোন কিছুই তদারকি করা সম্ভব হতো না। যে কারণে পূর্ববাংলা ছিল শিক্ষা, স্বাস্থ্য, ব্যবসা-বাণিজ্য, শিল্প- কল-কারখানায় অনুন্নত অবহেলিত অঞ্চল। প্রশাসনের সকল স্তরের পূর্বাঞ্চলের সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলিম জনসংখ্যা উপস্থিতি ছিল শতকরা পাঁচ ভাগেরও কম অথচ মুসলিম জনসংখ্যা ছিল শতকরা ৮০ ভাগ । এরূপ বর্ণ বৈষম্যের কারণে উন্নয়নের সকল স্রোত পশ্চিমবঙ্গের বর্ণহিন্দুদের থলেতে গিয়ে জমা হতো। একারণেই পূর্ব বাংলায় অভাব মহামারী দুর্ভিক্ষ লেগেই থাকত ফলে বেঙ্গল প্রভিন্সের গভর্নরদের সরকারের নিকট জবাবদিহি করতে হতো । ব্রিটিশ শাসনের দেড়শ বছর অতিক্রান্ত হওয়ার পর শুধুমাত্র প্রশাসনিক সুবিধার্থে ব্রিটিশ সরকার পূর্ববাংলার ওপর দয়াপরবশ হয়ে এ অঞ্চলের আর্থসামাজিক উন্নয়নের চিন্তা করে বৃহত্তর বেঙ্গল প্রভিন্সী বিভক্ত করে আসাম এর সাথে যুক্ত করে পূর্ববাংলা ও আসাম’ নামে ভিন্ন প্রদেশ গঠন করার চিন্তা করে। আর এই নবগঠিত বেঙ্গল ও আসাম প্রদেশের রাজধানী ঘোষণা করা হয় ঢাকাকে। পূর্ব বাংলা ও আসাম আলাদা প্রদেশ হবে, ঢাকা পুনরায় প্রদেশের রাজধানীর মর্যাদা পাবে অর্থাৎ পূর্ব বাংলার জনগনের সামাজিক অর্থনৈতিক রাজনৈতিক জীবনের উন্নয়ন সাধন হবে। কিন্তু পূর্ব বাংলার জনগণ তো শতকরা ৮০জনই নেড়ে, মোচলমান, অস্পর্স ম্লেচ্ছ। ওইসব চাষাভূষা অশিক্ষিত মূর্খ মোচলমানদের এলাকায় রাজধানী শহর হবে, এটা কলকাতার বাবু শ্রেণি কিভাবে বরদাস্ত করবেন।
এখানে আরেকটি ভয়ের কারণ ছিল পূর্ববাংলা যে সমস্ত জমিদারি ছিল তাদের শতকরা ৯৮ জন জমিদার ছিল হিন্দু সম্প্রদায়ের। যাদের মূল বসতভিটা ছিল কলকাতা, পূর্ববাংলাকে তারা মনে করত খামারবাড়ি। এই খামারবাড়ির রায়েত বা প্রজাদের রাজনৈতিক ও সামাজিক মর্যাদা আসবে, জমিদার বাবুদের খামারবাড়িতে রাজধানী শহর স্থাপিত হলে কলকাতা থেকে পূর্ব বাংলায় জমিদারীর ঠাটবাট বজায় রাখা অত্যন্ত কঠিন হবে। মূলত এ কারণেই পশ্চিমবাংলার কলকাতা শহরে বসবাসকারী পূর্ব বাংলা জমিদার বাবু সম্প্রদায় এই বঙ্গভঙ্গকে কোনক্রমেই মেনে নিতে পারছিল না। কিন্তু সমস্যা হল এই গোপন কথা তো প্রকাশ্যে বলা যাবে না। তাই তারা অনেক চিন্তা ভাবনা করে অত্যন্ত স্পর্শকাতর বাক্য দ্বারা তাদের কার্যসিদ্ধির চিন্তা করতে লাগল। তারা অত্যন্ত চতুরতার সাথে বাংলাকে মায়ের সাথে তুলনা করে রচনা করলো–
“মা তোর বদনখানি মলিন হলে –আমি নয়ন জলে ভাসি”
দেশের মাটিকে মায়ের বদন অর্থাৎ মায়ের শরীর বা মাতৃভূমি বলে উপস্থাপন করলো। বাংলা প্রদেশ বিভক্তি মানেই মাকে দ্বিখন্ডিত করা । (যদিও সেটা দেশ বিভাগ ছিল না, শুধুমাত্র প্রশাসনিক বিভক্তি, এখন যেমন আমাদের দেশে নতুন নতুন জেলা বা থানা তৈরি করা হচ্ছে তেমনি ছিল) দেশমাতার সন্তান হয়ে কিভাবে মায়ের শরীরকে দ্বিখন্ডিত করা দেখা যেতে পারে। তাই এই সঙ্গীতের ঢেউ গঙ্গা ভাগীরথী পদ্মা মেঘনা যমুনার তীরে বর্ণহিন্দুদের মাঝে আঁচড়ে পড়ল। এই সংগীতের তোরে পশ্চিমবাংলার বর্ণ হিন্দু সম্প্রদায় একজোট হয়ে তুমুলভাবে বঙ্গভঙ্গ বিরোধী আন্দোলন করে ব্রিটিশ সরকারকে ছয় বৎসর পর অর্থাৎ ১৯১১ সালে বঙ্গভঙ্গকে রোধ আইন পাস করতে বাধ্য করা হলো। এই হলো দেশপ্রেম মানে মাতৃভূমি মাতৃভক্তির নমুনা কথা। সেই বিংশ শতাব্দীর শুরু থেকেই ‘মাতৃভূমি মা’ একথার যেমন প্রচলন হয়েছে তেমনি দেশের মানুষও দেশকে মা জননীর মতোই শ্রদ্ধা ও ভালোবেসে এসেছে।
দেশভাগ মানে মাতৃভূমিকে বিভক্ত করা, যদিও দেশ বিভক্ত ছিল না শুধুমাত্র প্রশাসনিক বিভক্ত ছিল, তবুও তারা প্রশাসনিক বিভক্তিকে মাকে- দ্বিখণ্ডিত করা হয়েছে বলে আন্দোলন করেছিল। যখন দেশ বিভক্তির বিরুদ্ধে আন্দোলন করেছিল তখন ঐ সমস্ত বর্ণহিন্দুরা নাবালক অর্থাৎ ছোট ছিল। কিংবা বলা চলে তাদের হাতে প্রশাসনিক বা রাজনৈতিক ক্ষমতা তেমন জোরালো ভাবে আসে নাই। তাই তারা ছোটকালের দুগ্ধপোষ্য শিশুর মত মায়ের আঁচল ধরে সকাল সন্ধ্যা মা মা করে কাটিয়েছি। কিন্তু যখন তারা বড় হল রাজনৈতিক এবং প্রশাসনিক স্বাধীকার পাওয়ার পথে আগালো, ঠিক তখনই তারা নিজেদের স্বার্থে মাকে শুধুমাত্র দ্বিখণ্ডিত নয়, ছয় খন্ডে বিভক্ত করতেও তাদের বিবেক এতোটুকু বাধা দিলো না। কারণ ইতিমধ্যে তারা অনেক বড় হয়েছে, বয়সন্ধি পেরিয়েছে যৌবন প্রাপ্ত হয়েছে।
এই প্রসঙ্গে আমার কিছু স্মৃতি মনে পড়ে যায়–ঘটনা হল ছোটবেলায় আমাদের বাড়িতে অনেকগুলি গরু ছিল। একটি গরু ছিল যার নাম ছিল লাল গাই। এই লাল গাই প্রতি বছর বছর বাছুর দিত। এঁড়ে বাছুড় বকনা বাছুড়গুলো বড় হলে সমস্যা দেখা দিত, তাহলো এঁড়ে বাছুর যখন যৌবন প্রাপ্ত হয়,তখন কোনটা তার গর্ভধারিনী মা, কোনটি তার সহোদর বোন সে বিষয়ে তার জ্ঞান সম্পুন্নভাবে লোপ পেয়ে যায়, তার কাছে মা বোন কোন বাদ বিচার থাকেনা।
কিন্তু আমরা তো মানুষ, আমরাতো সৃষ্টির সেরা জীব, আমরা কিভাবে চতুষ্পদ জন্তু জানোয়ারের কাতারে নেমে যেতে পারি। আমরা এই মানুষ নামের সর্বশ্রেষ্ঠ প্রানীটি কিভাবে জন্তু জানোয়ারের মতো মাতৃভক্তির জ্ঞান হারিয়ে ফেলতে পারি। জন্তু জানোয়ারের মত বিবেক বুদ্ধি লোপ পাওয়ার কারণেই সেদিন কলকাতার বঙ্গমাতার সন্তানেরা আমাদের বঙ্গমাতাকে শুধু দ্বিখণ্ডিত নয়, ছয় খন্ডে বিভক্ত করে ফেলেছিলো। সেই ছয় খন্ডের একখণ্ড হলো আমাদের এই স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ। কিন্তু আধুনিককালের এই বঙ্গ মাতার কিছু সন্তান বঙ্গমাতার সাথে যে আচরণ করছে তা আমাদের দেশের সেই ছোটবেলার এঁড়ে বাছুর এর কথাই মনে করিয়ে দেয়।
ঠিক যেভাবে আমরা ছোটবেলায় ছাত্রজীবনে কতবার কত সুরে গেয়েছি –মা তোর বদনখানি মলিন হলে আমি নয়ন জলে ভাসি -আহারে এই সংগীত গেয়ে কত যে দেশপ্রেমের মন্ত্রে উজ্জীবিত হয়েছি, মাতৃভক্তির প্রমাণ দেওয়ার জন্য মন প্রাণ সব সময় ছটফট করছে কিন্তু দেশ সেবার কিংবা মাতৃসেবার সুযোগ পেয়ে আর মাকে চিনতে পারিনা। মাকে বুঝতে পারিনা, মায়ের ইজ্জত, আব্রু কিভাবে বিনষ্ট হয় সেটাও আমরা এঁড়ে বাছুর এর মত ভুলে যাই।
আমাদের দেশের হর্তাকর্তা মন্ত্রী মিনিস্টার বিশেষ করে আমাদের খোদ পররাষ্ট্র মন্ত্রী যখন বলে যে আমার এই দেশ,এই মাতৃভূমির সাথে আমাদের প্রতিবেশী দেশের স্বামী স্ত্রীর সম্পর্ক। আমার দেশমাতা,মা- মাতৃকা পার্শ্ববর্তী বড় দেশের স্ত্রী। তাও আবার বৈধ স্ত্রী নয়– অবৈধ স্ত্রী। সগর্বে বেশ হাসিখুশির সাথে শত শত সাংবাদিকদের সামনে এমন কথা বলে তৃপ্তির ঢেঁকুর তোলে, আনন্দে গদগদ হয়ে সংবাদকর্মীরা তা আবার প্রচার করে, তখন চিৎকার করে আমার বলতে ইচ্ছে হয়, দেশমাতা, মাগো তোমার শ্রেষ্ঠ সন্তানরা তোমাকে দ্বিচারিণী বানিয়ে ফেললো। আমার মা আমার দেশমাতা আমার পার্শ্ববর্তী দেশের স্ত্রীর সমতুল্য, ধরণী দ্বিধা হও, লজ্জায় ঘৃণায় ক্ষোভে দুঃখে কাউকে মুখ দেখাতে পারি না। তখন বিবেক আমাকে এত ছোট করে যে নিজেকে ছোটবেলার ওই এঁড়ে বাছুরটার চেয়েও অধম,ইতোর,হীনমন্য মনে হয়। কিন্তু লজ্জায় ঘৃণায় মুখ ফুটে সকলের কাছে বলতে পারি না। মানুষ বলে কথা–কারন আমরা তো সত্যি সত্যি মানুষ, এঁড়ে বাছুর নই।