আমরা যদি কোন ভাবে সাড়ে ১৪শ বছর পূর্বে আইয়ামে জাহেলিয়াতের যুগে আরব ভূমিতে ফিরে যেতে পারতাম তাহলে ভালোভাবে বুঝতে পারতাম আধুনিক যুগে পৃথিবীর এক প্রান্তে বঙ্গোপসাগরে কোল ঘেঁষে ক্ষুদ্র এ দেশে আধুনিক আইয়ামে জাহিলিয়াত বিরাজমান। আল্লাহ রাসূল মুহাম্মদ সঃ এর জন্মের পূর্বে এবং নবুয়ত প্রাপ্তির সময়ও মক্কার লোকেরা দলমত নির্বিশেষে বিভিন্ন গোত্র মিলিয়ে কাবাঘরকে বাইতুল্লাহ বলতো। বাইতুল্লাহ অর্থ আল্লাহর ঘর। অর্থাৎ তারা আল্লাহর অস্তিত্ব স্বীকার করত। তারা কথায় কথায় কাবার রব কাবার রব বলে দোয়া করত। কাবার রবের নামে কসম খেত। কাবা রবের উদ্দেশ্যে কোরবানি করত। কাবা তাওয়াফ করত। জিলহজ্জ মাসের নির্দিষ্ট দিনগুলিতে আরবের বিভিন্ন প্রান্ত হতে তীর্থযাত্রীরা কাবা ঘরের চারপাশে জমায়েত হতো। বাইতুল্লাহ তাওয়াফ করত, সাফা মারওয়া দুই পাহাড়ের মাঝে দৌড়াত, আরাফাতের ময়দানে অবস্থান করত,মিনায় পাথর নিক্ষেপ করত। এমনকি আজ আমরা যেভাবে মৃত্যু লাশের দাফন কাফন করি কবরে ঢেকে রাখি একইভাবে মক্কা বাসীরাও মৃত্যু ব্যক্তির দাফন কাফন করতো, কবরে ঢেকে রাখতো। বিয়েশাদী করত মোহরানা তালাক প্রথা তাদের মধ্যেও ছিল। আইয়ামে জাহেলিয়াতের যুগের বিয়ে-শাদী বিভিন্ন ধরনের ছিল। ঠিক তেমনি বর্তমান যুগেও ঘোষিত এবং অঘোষিত বিবাহ শাদি মিলিয়ে মোটামুটি ভাবে আমরা আইয়ামে জাহেলিয়াতের যুগে কাছাকাছি অবস্থান করছি। আইয়ামে জাহেলিয়াতের যুগের আরবাসীর সাথে বর্তমান যুগে আমাদের দেশের মানুষের অনেক জায়গায় প্রচন্ড মিল আছে।
আমি বলতে চাচ্ছি আইয়ামে জাহেলিয়াতের যুগে আরব সমাজের মানুষেরা যেমন ঈমান, আমল, সামাজিক রীতিনীতি ও কৃষ্টি-কালচারে অভ্যস্ত ছিল বর্তমান সময়ে এদেশের সাধারণ মুসলিমরা তেমনি ঈমান আমল ,সামাজিক রীতি নীতি ও কৃষ্টি-কালচার অনুসরণ করে । শতভাগ একই আছে এটা বলা মুশকিল কিছু হিসেব-নিকেষের অবকাশ রয়েছে। কিন্তু আধুনিক জ্ঞান বিজ্ঞানের উন্নতির কারণে জীবন যাপন পদ্ধতি যেমন উন্নত হয়েছে ঠিক তেমনি ভাবেই ধর্মীয় রীতিনীতি ও আনুষ্ঠান সমুহের ব্যাপক পরিবর্তন সাধিত হয়েছে। পোশাকে আশাকে এবং ধর্মীয় অনুষ্ঠানাদিতে সদল বলে উপস্থিতির মধ্য দিয়ে খাঁটি মুসলমান কিংবা পাক্কা ঈমানদার পরিলক্ষিত হলেও আকিদা বিশ্বাসে, পারিবারিক, সামাজিক, অর্থনৈতিক কিংবা রাষ্ট্রীয় কৃষ্টি কালচারে ইসলামের প্রাথমিক যুগের আরব বাসীদের মতোই অবস্থা। অনেক বিষয়ে মিল আছে তার মধ্যে প্রধান প্রধান কয়েকটি বিষয়ে আলোচনা করতে চাই—
১। কাবার রবকে অর্থাৎ আল্লাহকে সৃষ্টিকারী স্বীকার করে নেওয়ার পরও লাত, মানাত, উজ্জা ও হুবালকে কাবার রবের প্রতিনিধি, কার্যসম্পাদনকারী, ফরিয়াদ শ্রবণকারী, আবদার পূরণকারী শক্তি সম্পন্ন মনে করা হতো।
আমাদের দেশের মুসলিমরাও তাদের নিজেদের পীরকে এমনই মনে করে থাকে যে তাঁরা আল্লাহ প্রাপ্তির সহায়ক।এ সকল পীরেরা আল্লাহ প্রদত্ত অলৌকিক ক্ষমতার অধিকারী। এ সকল পীরেরাও গায়েবের খবর জানে। তারা পীরের দয়ায় ভালো থাকে, পীরের দয়ায় তাদের মঙ্গল অমঙ্গল, সন্তান প্রাপ্তি, ব্যবসা বাণিজ্যে উন্নতি হয়।
২ । আরব সমাজে মূর্তিপূজার প্রচলন ছিল আমাদের সমাজেও মাজার পূজা, কবর পূজা, পীর পূজা ও পীরের আসনের পুজার প্রচলন আছে। তারা মুর্তির উদ্দেশ্যে মানত করতো, কোরবানি করতো, আমরাও মাজারের উদ্দেশ্যে, ওরশের জন্য মানত করি, গরু ছাগল হাঁস মুরগির নজরানা পেশ করি।
৩। আইয়ামে জাহেলিয়াতের যুগে আরব সমাজে পর্দা প্রথার প্রচলন ছিল না। আমাদের দেশেও নারী-পুরুষ যে যার রুচিমত অর্ধ-উলঙ্গ পোশাক পরিধান করে।
৪। আইয়ামে জাহেলিয়াতের যুগে আরব সমাজে মদ হালাল পানীয় ছিল এবং সর্বত্র জুয়ার প্রচলন ছিল। ঠিক তেমনি এদেশেও অনুমতি সাপেক্ষে মদ, হাউজি, কেসিনো জুয়ার আসর চালু আছে।।
৫ । আরব সমাজে যেনা ব্যাভিচারের প্রচলন ছিল, আমাদের সমাজেও আছে। তাদের সমাজে বিভিন্ন ধরনের বিবাহের প্রচলন ছিল, আমাদের সমাজেও গার্লফ্রেন্ড, লিভ টুগেদার, পরকীয়া বেশ জমজমাট ভাবেই চলছে। আরবের অভিজাত বংশীয় নারীরা যেনা-ব্যভিচারকে নিজেদের জন্য অপমানজনক মনে করলেও আমাদের সমাজের অভিজাত বংশীয়রা ঐ সব কাজকে নিজেদের জন্য আভিজাত্যের প্রতীক মনে করে।
৬। আরব সমাজে সুদের লেনদেন যেমন সর্বত্র প্রচলিত ছিল তেমনি ভাবে আমাদের সমাজেও রাষ্ট্রীয়ভাবে সকল লেনদেন সুদের মাধ্যমে পরিচালিত হয়।
৭। আরব সমাজে নারীকে পণ্য ও ভোগের সামগ্রী মনে করা হতো, এদেশেও নারীদেরকে নাটক, টিভি সিরিয়াল,সিনেমা, বিজ্ঞাপন ও বিভিন্ন সামাজিক অনুষ্ঠানে নারীকে বাণিজ্যিকভাবে মডেল বানানো হচ্ছে।
৯। আরব সমাজে মানুষের জানমালের নিরাপত্তা ছিল না, গোত্রে গোত্রে হানাহানি কাটাকাটি ছিল, দুর্বলের সম্পদ শক্তিশালীরা লুন্ঠন করত। আমাদের সমাজে শক্তিশালীরা দুর্বলের সম্পদ লুট করছে, জায়গা জমি দখল করছে, হত্যার পর লাশকে কেটে টুকরো টুকরো করা হচ্ছে। দলে দলে হানাহানি কাটাকাটি মারামারি বোমাবাজি নিত্যদিনের ঘটনা।
১০। আরব সমাজে কন্যা সন্তানকে হত্যা করা হতো জীবিত কবর দেওয়া হতো। আমাদের সমাজেও হচ্ছে, যত্রতত্র ডাস্টবিনে রাস্তার ধারে জঙ্গলে নবজাতককে ফেলে দেওয়া হচ্ছে।
১১। আরব সমাজ আল্লাহকে মানলেও আল্লাহর প্রেরিত রাসূল সঃ কে মানতে অস্বীকার করেছিল। আমরা আল্লাহ ও রাছুলকে মুখে স্বীকার করলেও ব্যক্তিগত, পারিবারিক, সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় জীবনে রাসূল সঃ এর অনুসরণ না করে রাজনৈতিক দল ও নেতৃত্বের অনুসরণ করি।
১২। বিবাহ সাদি থেকে শুরু করে খাতনা পর্যন্ত সকল সামাজিক অনুষ্ঠানে আমরা পৈত্তলিক সংস্কৃতিকে অনুসরণ করি। জাহেলিয়াতের যুগের মত আমরা আমাদের প্রতিটি সামাজিক অনুষ্ঠানকে অশ্লীল নাচ গানের মাধ্যমে উপভোগ করি।
১৩। জাহেলিয়াতের যুগে আরব সমাজের সাধারণ মানুষের আত্মসম্মান বোধ ছিল, স্বাধীনচেতা মন ছিল, আমাদের তাও নেই। এদেশের মসজিদের ইমাম, মোয়াজ্জিন, মুসল্লী ও সাধারন জনগনসহ রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ ব্যক্তি পর্যন্তকোনোভাবেই ঘুষ দিচ্ছে– ঘুষ খাচ্ছে, দুর্নীতি করছে। একজন ঘুষখোর ব্যাক্তিগতভাবে হাজার হাজার লক্ষ লক্ষ মানুষের নিকট থেকে জোরপূর্বক ঘুষ নিচ্ছে জাহেলীয়াতের যুগে এমনটা কল্পনাও করা যেত না।
এমনি যুগে জন্মেছিলেন রাসূলুল্লাহ সঃ। নবর প্রাপ্তির পর তিনি মক্কায় ১৩ বছর অবস্থান করেছেন এবং মক্কার সর্বসাধারণের নিকট দ্বীনের দাওয়াত দিয়েছেন। যারা দাওয়াত গ্রহণ করেছে তাদেরকে সংগঠিত করেছেন। তাদেরকে দ্বীন ইসলামের বিভিন্ন বিষয়ের উপর প্রশিক্ষণ দিয়েছেন। পরিশেষে এই প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত সাহাবায়ে কেরামকে নিয়ে মদিনায় হিজরত করে মদিনার বুকে ইসলামী খেলাফত কায়েম করে বাতিলের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছেন, সম্মুখ সমরের অবতীর্ণ হয়েছে। মদিনা সনদ ঘোষণার মাধ্যমে ইসলামী প্রশাসন প্রতিষ্ঠা করেছেন। রাসূলুল্লাহর (সঃ) মদিনায় রাষ্ট্রব্যবস্থা প্রতিষ্ঠিত হওয়ার আগ পর্যন্ত মক্কার ১৩ বছর জিন্দেগীতে শরীয়তের সুনির্দিষ্ট কোন বিধি-বিধান ছিল না। যেমন মক্কার জীবনে পর্দা ফরজ হয়নি মদ হারাম হয়নি সুদকে পাপ ঘোষণা করা হয়নি, চুরি ডাকাতি জেনা বেবিচারের শাস্তি নির্ধারণ করা হয়নি এমনি আরো অনেক অনেক বিষয়ে আল্লাহ রাসুল মক্কা জিন্দেগীতে মদিনার মত ইসলামী ফিকার প্রচলন করেন নি। তখন একটাই লক্ষ্য ছিল ইসলামিক খেলাফত প্রতিষ্ঠা করা। ইসলামিক খেলাফত প্রতিষ্ঠার পর থেকেই ইসলামী ফেকাহ অনুসরণ শুরু হয়েছে। কিন্তু এখন প্রশ্ন জাগে, আমাদের দেশের সমাজ ব্যবস্থা কোন যুগে আছে, আমাদের সমাজে কি ইসলামী খেলাফত প্রতিষ্ঠা আছে? না নেই, আমরা ইসলামিক খেলাফত প্রতিষ্ঠার আন্দোলনে আছি। তাই যদি হবে তাহলে আগে ইসলামিক খেলাফত তারপরে ইসলামী ফিকাহ অনুসরণ, তারপরে ফেকাহর বিধিবিধান নিয়ে মতবিরোধ হতে পারে। কিন্তু আমাদের দেশে ইসলামী খেলাফত কায়েমের আগেই খেলাফত কায়েমের আন্দোলনকে ফেকাহ‘র বিধিবিধানে আষ্টেপিষ্টে বেধেঁ ফেলা হচ্ছে। বাস্তব ময়দানের দাবী হলো ইসলামী খেলাফত প্রতিষ্ঠার কাজকে সবচেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ন মনে করা। সর্বপ্রথম খেলাফত প্রতিষ্ঠা তারপর দ্বীন ইসলামের বিভিন্ন ছোট-বড় বিষয়ে ফেকাহর বিধি-বিধান। এ দেশে ইসলামী ছোটখাটো বিষয় নিয়ে মতবিরোধের পর মত বিরোধ করতে করতে খেলাফত প্রতিষ্ঠার কাজকে এত বেশি পরিমাণে বাঁধা গ্রস্থ করছি যে ভবিষ্যতে এদেশে ইসলামী খেলাফত প্রতিষ্ঠা আদৌ সম্ভব কিনা প্রশ্ন হয়ে দাঁড়িয়েছে। তারপরও আমরা মতবিরোধ কমাতে পারছি না, একদিন মহান রবের আদালতের জবাবদিহি করতে হবে এই অনুভূতি কবে আসবে তারই অপেক্ষায়।