জীবনে হাফ সেঞ্চুরি হাফ ডজন বসন্ত পেরিয়ে ছোটবেলার দাদুর কথা বার বার মনে পড়ছে। দাদু বলতেন-মানুষের পেটের ক্ষুধার চেয়ে চোখের ক্ষুধা অনেক বেশি। যা কখনোই মেটে না, মিটানো যায় না।
গত ক‘দিন ধরে এবিষয় চিন্তা করে কোন কুল কিনারা পাচ্ছিনা। ইসলামের ইতিহাসে দেখা যায় যাকাতের টাকা নিয়ে যাকাত বিভাগের কর্মচারীরা রাস্তাঘাটে পাড়ায় মহল্লায় ঘোরাফেরা করতো কিন্তু যাকাতের টাকা নেওয়ার মতো কেউ ছিল না। কারো প্রয়োজন নেই,যাকাত নিতে কেউ রাজি হতো না, দেশের সব নাগরিক একবারে ধনী হয়েছিলো, যাকাত বা ফিতরা গ্রহণে উপযুক্ত কেউ থাকবে না, এটা কিভাবে সম্ভব হতে পারে। এটা ভাবতে ভাবতে কয়েকদিন কেটে যাওয়ার পর, আসন্ন ঈদুল ফিতর উপলক্ষে ফেতরার খাদ্যসামগ্রী বিতরণ করতে গিয়ে একজনের কথা শুনেই আমার ছেলেবেলার দাদুর কথা মনে হয়ে গেল।
তিন যুগের বেশি সময় ধরে সামাজিক কাজ করছি। বিভিন্ন দুর্যোগের ত্রাণ সামগ্রী, ঈদ সামগ্রী, কোরবানির গোশত বিতরণ শুরু করলে আর শেষ করা যায় না। শত প্যাকেট হোক, কিংবা হাজার হোক কোন কিছুতেই গৃহীতার অভাব হয় না, এ যেন শেষ করা যায় না। এই যদি হয় জনগণের অবস্থা তাহলে ইসলামের ইতিহাসে যে তথ্য পাওয়া যায় সেটা কিভাবে সম্ভব হয়েছিল এটাই ছিল আমার চিন্তার বিষয়।
ইসলামী খেলাফতের সময় দেশের সব নাগরিক কি সাহেবে নেসাব হয়েছিলেন, তখন কি গরিব কেউ ছিলনা? নাকি গরিব থাকলেও তাদের মন গরিব ছিলনা, গরিব হলেও ইসলামী জ্ঞানে, ঈমান আকিদায় তারা ধনী ছিলেন, তারা অন্যকে নিজের চেয়ে বেশি প্রাধান্য দিয়েছিলেন। হয়তো এ কারণেই যাকাত-ফিতরা গ্রহণের লোক খুঁজে পাওয়া যেতনা। তারা অতি সামান্যতেই তুষ্ট থাকতো, আল্লাহর উপর ভরসা করে রিজিকের জন্য পরিশ্রম করত, একদিনের খাবারের ব্যবস্থা থাকলে যাকাত ফেতরা গ্রহণ করত না। সম্পদ অর্জন এবং সঞ্চয় করার প্রতিযোগিতা ছিল না। তাই হয়তো ইসলামের ইতিহাসে এক নতুন অধ্যায়ের সৃষ্টি হয়েছিল।
কিন্তু আমাদের দেশের প্রেক্ষাপট সম্পূর্ণ ভিন্ন, এদেশে কাজ না করে খেতে পেলে খুবই ভালো। এখানে ভিক্ষা নিরুপায় কিংবা অক্ষম ব্যক্তির বেঁচে থাকার ব্যবস্থা নয়। ভিক্ষা এদেশে জনপ্রিয় পেশায় পরিণত হয়েছে। ভিক্ষুকের সংখ্যা দিনদিন বেড়েই চলছে, বিভিন্ন ওয়াক্তের নামাজে, জুমা কিংবা ঈদের নামাজের আগে ও পরে মসজিদের পাশে দাঁড়িয়ে থাকে এরকম ভিক্ষুকদেরকে নামাজ পড়তে দেখা যায় না। এদেরকে অসহায় দুর্বল কিংবা প্রতিবন্ধী মনে হলেও প্রত্যেককেই ওদের পরিবারের প্রধান কর্তা, ছেলে মেয়ে জামাই নাতিপুতি নিয়ে বিরাট সংসার চলে ভিক্ষার টাকায়, এরা গ্রামে জমি কিনে বাড়ি করে, এমনও দেখা যায় ভিক্ষুক মারা যাওয়ার পর তার বিছানার তলে কিংবা ঝোলার ভিতর লক্ষ লক্ষ টাকা।
এদেশে প্রতি হাজারে এক দুজন লোক পাওয়া যাবে না যাদের একদিন বা একবেলার খাদ্যের যোগাড় নেই। খাদ্যের অভাবে কেউ অনাহারে আছে এমন কাউকে খুঁজে পাওয়া সত্যিই কঠিন। যাদের এক দুই মাসের খাদ্যের জোগাড় আছে তারাও ফেতরার খাদ্য সামগ্রী হাত পেতে নিচ্ছে। না দিলে মন খারাপ করছে। ছোটোখাটো কাজ করে ২-৪ লক্ষ টাকা সঞ্চয় করেছে, সে ব্যক্তিও নির্দ্বিধায় যাকাত ফিতরার জন্য হাত পাতছে। জিজ্ঞেস করলে বলবে আমি গরিব মানুষ আমার কি এমন সম্পদ আছে। সত্যিই তো কোটি টাকার তুলনায় লাখ টাকা কিছুই না, তার লক্ষ টাকা আছে কিন্তু সে কোটি টাকার জন্য গরিব।
ভিক্ষুক থেকে শুরু করে সাধারণ সাহায্য প্রার্থী এদের পেট যেন কখনোই ভরে না। ঘরে ঘরে গিয়ে হাত পেতে সর্বনিম্ন ১০কেজি থেকে ৫০কেজি কোরবানির গোস্ত সংগ্রহ করে। অথচ ঈদের দিনে তার পরিবারের জন্য ২/৩ কেজি গোস্তই যথেষ্ট, কেউ বলে না আমার যথেষ্ট হয়েছে, অন্যদেরকে দিন। ঠিক যেমন পেশাদার ব্যবসায়ী বেচাকেনা কখনোই বন্ধ করে না। লক্ষ কোটি টাকা লাভ হচ্ছে তারপরেও ভেজাল দিচ্ছে অনিয়ম করছে। সম্পদ অর্জনের প্রতিযোগিতা যেন থামছেই না। যাকাত ফিতরা ও ভিক্ষা যা পাও হাত পেতে নাও, সর্বত্র একই চিন্তা, সঞ্চয় বাড়াতে হবে। বছরের পর বছর ধরে আমরা সামাজিক কাজ করে যাচ্ছি। গৃহীতার সংখ্যা কমেছে না জ্যামিতিক হারে বেড়েই চলছে । এটা একটা সামাজিক ও মানসিক ব্যাধিতে পরিণত হয়েছে। এর প্রকৃত কারণ অনুধাবন করে এ ব্যধির যথাযথ চিকিৎসার ব্যবস্থা করতে পারছিনা।
যাদেরকে অভাবী হতদরিদ্র ভেবে সাহায্য করছি তারা কিন্তু প্রকৃতপক্ষেই নিঃস্ব নয়। প্রত্যেককের কিছু না কিছু সম্পদ আছে, খাবারের ব্যবস্থা আছে। কিন্তু তারা ইসলামী জ্ঞানের অভাবে অভাবী, ঈমান ও আক্বীদায় একেবারে নিঃস্ব, যদি এ জনগোষ্ঠীর মাঝে দ্বীন ইসলামের প্রকৃত রূপ তুলে ধরা যেত তাহলে স্বচ্ছতা জবাবদিহিতা ও ইনসাফ ভিত্তিক সমাজ প্রতিষ্ঠার জন্য তারা জীবনপণ সংগ্রাম করত। কিন্তু দীর্ঘ কাল যাবত অন্যায় ও জুলুমের শিকার হতে হতে এ দেশের মুসলিমদের মন মানসিকতায় হীনমন্যতা ও দ্বীনের বিমুখতা সৃষ্টি হয়েছ।
এরূপ মন-মানসিকতার অন্যতম কারণ হলো সামাজিক নির্যাতন ও প্রশাসনিক জুলুম। সুদযুক্ত অর্থব্যবস্থার আষ্টেপিষ্টে বাঁধায় পড়ে আছে দেশের সাধারণ মানুষ। ঘুষ দুর্নীতি চাঁদাবাজি সহ্য করেও সামাজিক নিরাপত্তা পাচ্ছে না। প্রশাসনিক ও সামাজিক নিরাপত্তাহীনতায় যারা ভোগে তারা সর্বদায় ভবিষ্যৎ অন্ধকার দেখে, তাইতো বাধ্য হয়ে যে কোনো প্রকারে সম্পদ অর্জনের প্রতিযোগিতা শুরু হয়। জবাবদিহিতা ও ইনসাফ ভিত্তিক সুশাসন প্রতিষ্ঠা হলে সামাজিক নিরাপত্তা ফিরে আসে। দেশের নাগরিকরা প্রশাসনের প্রতি আস্থাশীল হয়। পারস্পারিক ভ্রাতৃত্ব এবং সামাজিক দায়বদ্ধতায় সারাদেশের মানুষ সীসাঢালা প্রাচীরের মত দাঁড়িয়ে যায়। আল্লাহ রিজিকদাতা এই বিশ্বাস এতই দৃঢ় হয় যে একদিন বা এক বেলার খাবারের ব্যবস্থা থাকলে কেউই যাকাত ও ফিতরা গ্রহণ করবেনা। আল্লাহর উপর ভরসা এতই বেড়ে যাবে যে আগামীকাল কি খাবো, কোথায় থাকবো,পরিবার-পরিজনের কি হবে এই চিন্তায় কেউ ব্যাকুল হবে না, ভালো-মন্দ, জীবন মৃত্যু, ধনসম্পদ, সুখ শান্তি এসবের একচ্ছত্র মালিক মহান আল্লাহ। এটা ভেবেই দ্বীনকে ধারণ করে নিজ নিজ কর্ম করবে, তখন এদেশেও হাত পেতে যাকাত ফেতরা নেওয়ার মানুষ খুঁজে পাওয়া যাবে না।
ফিতরা আদায়ের ব্যাপারে ইমাম শাফি রহঃ যে মতামত দিয়েছেন তা হলো ঈদের দিন যার ঘরে অন্তত একদিনের বা একবেলার খাবার থাকবে তাকে ফেতরা আদায় করতে হবে। যাকাত দাতা যাকাত দিচ্ছেন ভিক্ষার মতো, কিংবা আল্লাহর নির্ধারিত আটটি খাতের বাইরে নির্দ্বিধায় যাকাত দিচ্ছেন। যিনি সাহেবেনিসাব তিনিও যাকাত গ্রহণ করছেন। এমন অনিয়মের প্রধান কারণ হলো- কোন জনপদে আল্লাহ প্রদত্ত দ্বীন কায়েম না থাকলে সে জনপদের মানুষ শরীয়তের নির্ধারিত ফরজ ওয়াজিব বিধানসমূহকে যথাযথভাবে পালন করতে পারেনা। যাকাত, ফিতরা দেওয়া-নেওয়ায় অনিয়ম, সামাজিক ব্যবস্থাপনায় অনিয়ম, প্রশাসনিক জুলুম ঘুষ দুর্নীতি, চাঁদাবাজি দুর্বলের উপর সবলের অত্যাচার এর জন্য কি শুধু সংশ্লিষ্টরাই দায়ী। না প্রকৃতপক্ষে এর দায়ভার সমাজের ওই সকল কর্তা ব্যক্তি ও ঐ সকল নামাজি রোজাদার হাজী যারা সমাজ নিয়ন্ত্রণ করে ও শুধু নিজের জন্য ইবাদত করে। মহান আল্লাহ খিলাফতের দায়িত্ব দিয়ে এই পৃথিবীতে প্রেরণ করেছেন, তাঁর বিধান অনুযায়ী পৃথিবীর ব্যবস্থাপনা পরিচালনা করার জন্য। নানান অজুহাতে প্রধান দায়িত্ব পাশ কেটে গিয়ে নামাজ রোজা ও হজ্জ নিয়ে আল্লাহর দরবারে মুক্তি চাচ্ছি। যে কাজের জন্য সৃষ্টি করা হয়েছে সে কাজ না করলে মুক্তি কিভাবে হবে। খেলাফতের দায়িত্ব পালন না করলে, সাধারণ ভুক্তভোগী,অনিয়মকারী, জালিম মজলুম, সামাজিক ও প্রশাসনিক হর্তাকর্তা, ইমাম-খতীব, নামাজি, রোজাদার, হাজীসাহেবসহ সবাইকে আদালতে আখেরাতে আসামীর কাঠগড়ায় দাঁড়াতে হবে, সেদিন মুক্তি পাওয়ার কোন যুক্তি থাকবে না।
ইবনে শাহ