মানব জাতি বিশেষ করে মুসলিমরা বিশ্বাস করে তারা আল্লাহর প্রতিনিধি। মহান আল্লাহতালা আল কোরআনে সূরা বাকারার ৩০ নম্বর আয়াতে বলেছেন–“আর স্মরণ করুন, যখন আপনার রব ফেরেশতাদের বললেন, ‘নিশ্চয় আমি যমীনে খলীফা সৃষ্টি করছি’। ইহা ছাড়াও আল কুরআনের বিভিন্ন স্থানে মানুষের মূল দায়িত্ব কি সে বিষয়ে আলোকপাত করা হয়েছে। প্রত্যেক মুসলমানই কোনো না কোনো ভাবে জানে এবং সে বিশ্বাসও করে যে, সে আল্লাহর খলিফা, খেলাফতের দায়িত্ব দিয়ে পৃথিবীতে প্রেরিত হয়েছে।
মহান আল্লাহ একমাত্র সৃষ্টিকারী, তার বিধান অনুযায়ী হালাল পন্থা অবলম্বন করা, মিথ্যা না বলা, চুরি ডাকাতি খুনখারাবি জেনা ব্যাভিচার,সুদ,ঘুষ অত্যন্ত জঘন্য অপরাধ। এসব অপরাধ করলে পরকালে অনন্তকাল কঠিন শাস্তি ভোগ করতে হবে। ধর্মীয় এই অনুভূতি মুসলিমদের আবাল বৃদ্ধ বনিতা সবাই জানে, ব্যতিক্রম শুধু প্রতিবন্ধী, পাগল, কিংবা নাস্তিক। তাই তো দেখা যায় জুম্মাবারে প্রতিটি মসজিদে জুম্মার সালাতে উপচে পড়া ভিড়। দুই ঈদের নামাজে তো কোন কথাই নেই। জুম্মার নামাজে শতকরা ৬০-৭০ ভাগ মুসলিমরা উপস্থিত থাকলেও দুই ঈদের নামাজে বলা চলে ৯৫% মুসলিম জামায়াতের শামিল হয়। নামাজে দাঁড়ায়, সুবহানা রাব্বিয়াল আজিম, সুবহানা রাব্বিয়াল আলা বলে রুকু সিজদাহ করে। শবে বরাতের রাত্রে গুনাহ মাফের জন্য এবং রিজিক বৃদ্ধির জন্য আল্লাহর দরবারে মোনাজাত করে কান্নাকাটি করে। এভাবে বলা চলে আমাদের দেশে মুসলিমদের মাঝে শতকরা ৯৫ জনেরও বেশি ধর্ম ভিরু। আল্লাহর প্রতি অকৃত্রিম ভালবাসা বিভিন্ন উৎসবে বা পর্বে প্রবালভাবে প্রদর্শিত হয়।
আল্লাহ, রাসূল (সঃ),আল-কুরআন,কিংবা মসজিদ ও মাদ্রাসার বিরুদ্ধে কেউ বিরূপ মন্তব্য বা হামলা করলে মুসলিমরা তৎক্ষনাৎ একজোট হয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করে। আমাদের দেশে জাতীয়তাবাদী এমনকি সেক্যুলার ধর্মনিরপেক্ষ দলের নেতাকর্মীরাও মসজিদে প্রথম কাতারে গিয়ে নামাজ আদায় করে, বর্তমান সময়ে তো ছোট বড় সব মসজিদে তারাই খেদমতে নিয়োজিত। কিন্তু সমস্যা হল ঐ সব নেতা কর্মীদেরকে ইসলামিক খেলাফত তথা দ্বীন কায়েমের কথা বললে তারা প্রচন্ড বিরোধিতা করে, ধর্মকে নিয়ে ব্যবসা, রাজনীতি, জঙ্গিবাদী, মধ্যযুগের বর্বরতা আবার ফিরিয়ে আনতে চান, ইত্যাদি ইত্যাদ বলা শুরু করে। অথচ তারা আল্লাহকে বিশ্বাস করে, মসজিদের খেদমত করে, মজার বিষয় হলো মসজিদে যে আল্লাহকে রুকু সিজদা করতেছে সেই আল্লাহর বিধান অনুযায়ী রাষ্ট্র পরিচালনার কথা আসলেই তার লাফ দিয়ে ওঠে প্রচন্ড রকমের বেঁকে যায়। তাদের ধারণা ইসলামী খেলাফত কিংবা ইসলামী সমাজ ব্যবস্থার কথা ধর্ম ব্যবসায়ী দলগুলোর নিজস্ব বানানো এবং ভন্ডামী। একদিকে ঈমানদার মুসলিম অন্যদিকে কাফের মানে ইকামতের দ্বীনকে অস্বীকার করা। কিন্তু কেন এই বৈপরিত্য। এর জন্য দায়ী কে?
ঈমানের দাবিদার যে মুসলিম ভাই ইকামতে দ্বীনকে অস্বীকার করে,ধর্ম নিয়ে রাজনীতি, জঙ্গি অসভ্য বর্বরতা মনে করে সে কিন্তু প্রকৃতপক্ষে খেলার পুতুল। কিংবা বলা চলে -তোতা পাখি, তাকে ছোটবেলা থেকে যে ইতিহাস মুখস্ত করানো হয়েছে, পরিণত বয়সে সে সেটাই উদগিরণ করে যাচ্ছে। শুধু তাই নয় সে বুঝতে পারে সমাজের সাধারন মানুষ ধর্ম নিয়ে রাজণীতি পছন্দ করে না। সুতরাং সে তো ইসলামী খেলাফতকে অস্বীকার করবে, এমনকি ইসলামিক খেলাফত বাস্তবায়নকারীদের উপর জুলুম নির্যাতন চালাবে এটাই স্বাভাবিক। অথচ তাকেই আমরা প্রকৃত অপরাধী মনে করি। এরকম ভ্রান্ত পথের যাত্রীকে আমরা প্রকৃত তাগুদ মনে করে শত্রু বানিয়ে ফেলি। কিন্তু এরকম নামাজি, ঈমানদার মুসলিমদেরকে ভ্রান্ত পথে কে নিয়ে গেল,কোথা থেকে ভ্রান্ত পথের সন্ধান পেলো, এ বিষয়গুলো আমরা অনুধাবন করিনা।
আরেকটি কথা আমরা যে বিষয়ের উপর লেখাপড়া করে উচ্চতর ডিগ্রি অর্জন করি বাস্তব জীবনে সেটারই প্রতিফলন ঘটে। আমাদের বেলায় অর্জিত জ্ঞান বাস্তব জীবনের প্রতিফলিত হলে যদি দোষের না হয়, তাহলে যে মুসলিম সন্তানদের ইসলামী খেলাফতকে উল্টা ভাবে বিকৃত করে শিক্ষা দেওয়া হয়েছে, তাদের বেলায় দোষ হবে কেন? কারণ পূর্বপুরুষদের শৌর্যবীর্য ও সুশাসন সে প্রত্যক্ষ করেনি। সে শিক্ষা লাভ করেছে একসময় ইসলামী খেলাফত ছিল। তারা একহাতে কোরআন অন্য হাতে তরবারি নিয়ে যুদ্ধ করেছে, অমুসলিমদেরকে কচুকাটা করেছে। অন্য ধর্মের লোকদেরকে জোর করে মুসলিম বানিয়েছে, দোররা মেরেছে, হাত কেটেছে, পাথর মেরেছে। একেকজন পুরুষ ইচ্ছামত বিয়ে শাদী করেছে। নারীদেরকে ঘরের মধ্যে বন্দি করে রেখেছে। অসভ্য বর্বর আইন রচনা করে উন্নয়ন, অগ্রগতি ও প্রগতিশীল চিন্তা চেতনাকে স্তব্ধ করে দিয়েছে। এ কারণেই মুসলিমদের আজ এই অবস্থা। মুসলিমরা পাশ্চাত্যের ইউরোপ এবং আমেরিকাকে কব্জা করতে পারেনি, এজন্যই তারা আজ অনেক উন্নত অনেক সভ্য।
এরকম ইতিহাস তারা শিখেছে, তার উপর ইসলামী স্বর্ণযুগের ইতিহাস, উন্নয়ন ও সভ্যতাকে অস্বিকার করা হচ্ছে। আল কোরআনে বর্ণিত যুলকারনাইন বাদশাহ এবং প্রসিদ্ধ জ্ঞানী লোকমান হাকিমের মত আমাদের জামানার ন্যায়পরায়ণ বাদশা এবং জ্ঞানী ব্যক্তিদেরকে চরিত্রহীন লম্পট দুরাচার হিসেবে তাদের সামনে পেশ করা হয়েছে। এর বাইরে সঠিক ইসলামী ইতিহাস ঐতিহ্য শিক্ষা লাভ করার কোন উপায় উপকরণ নেই, ইসলামী স্বর্ণযুগের প্রকৃত ইতিহাস তারা জানেনা। শিশু কাল থেকে তাদেরকে শেখানো হয়েছে এবাদত অর্থ নামাজ রোজা হজ্ব যাকাত আর দ্বীন ইসলামের কাজ মানেই মসজিদ মাদ্রাসার খেদমত করা। সকল প্রকার দান খয়রাত মসজিদ মাদ্রাসা এবং এতিম মিসকীনদেরকে করতে হবে। যাকাতের শাড়ি লুঙ্গি আত্মীয় স্বজনদেরকে আগে দিয়ে শুরু করতে হবে। মসজিদে দুনিয়াবী কথা বলা হারাম, রাজনীতি খুব খারাপ বিষয়, দ্বীন ইসলামকে নোংরা রাজনীতি থেকে মুক্ত রাখতে হবে। তাইতো বড় হয়ে তারা তাদের শিক্ষার বাস্তব প্রয়োগ ঘটাচ্ছে।
ঠিক এরকম ঈমানদার ব্যক্তিদের মধ্যে যারা একটু নরম প্রকৃতির, কিংবা ডানপন্থী স্বভাবের তাদের ২৫% এর নিকট আমরা দ্বীন কায়েমের দাওয়াত নিয়ে হাজির হচ্ছি। এদের সাথে সুসম্পর্ক স্থাপন করি, ইসলামের বিভিন্ন বিষয়ে পড়াশুনা করাই, এদের মধ্যে অনেকেই নিজেদের ভুল বুঝতে পারে এবং পরিশুদ্ধ হয়। এই ২৫% এর মধ্য থেকে হয়ত খুব জোর অর্ধেককে দ্বীন কায়েমের আন্দোলনের কর্মী সমর্থক বানিয়ে ফেলি। হিসেব করে দেখা যায় মোট জনসংখ্যা ৭৫% এর নিকট আমরা পৌঁছিতে পারছি না। এভাবে আমাদের আন্দোলন শম্মুক গতিতে চলছে, আর অন্যদিকে তাগুদ রকেটের গতিতে দ্বীন-ইসলাম বিরোধী অদৃশ্য সুতার জাল বিস্তার করে চলছে।
বর্তমানের প্রচলিত ধারায় ইসলামী আদর্শিক চিন্তা চেতনাকে এর বেশি অগ্রসর করতে পারছি না। কারণ আমরা নিজেরাই ইসলামী ইতিহাস ঐতিহ্যের চর্চা করছি না। আমাদের সংশ্লিষ্ট ভূখণ্ডের অতীত ইতিহাস,আমাদের পূর্বপুরুষদের ইসলামী সালতানাতের হাজার বছরের শাসন, উন্নত সভ্যতার প্রচলন, ধর্ম বর্ণ নির্বিশেষে প্রতিপালন সম্পর্কে আমরা কতটুকু জানি। এমনকি আমাদের এই এশিয়া মহাদেশের ইসলামী সালতানাত গুলোর উত্থান পতন, শাসন প্রণালী, যুদ্ধবিগ্রহ,শৌর্যবীর্য, সম্পর্কে কতটুকু জানি। নিজেদের সঠিক শিক্ষা না থাকার কারণে আমরা আমাদের শতভাগ জনসাধারণের ভুল ধারণার অপনোদন করার উদ্যোগ নিতে পারছি না।
যেভাবে আমাদের ইতিহাসকে বিকৃত করা হয়েছে, ইসলামী ব্যক্তিত্বের, ইসলামী শাসক গোষ্ঠীর চরিত্র হনন করা হয়েছে, তার তুলনায় সঠিক ইতিহাস ঐতিহ্যের প্রচার ও প্রসারের উদ্বেগ গ্রহণই হচ্ছে না। ইসলামী হুকুম আহকাসের যে সকল বিষয়ে আমাদের সাধারণ জনগণ কিছুটা অবগত আছে, আমরা পুনঃ পুনঃ সেই বিষয়ের দাওয়াত দিচ্ছি। কিন্তু যে বিষয়গুলো সম্পর্কে আমাদের সাধারণ জনগণ একেবারে অজ্ঞ, ভুল ধারণা নিয়ে বসে আছে, বিকৃত ইতিহাস পড়ে আমাদের চরম বিরোধিতা করছে, সে সকল বিষয়ের সঠিক ইতিহাস ঐতিহ্য তাদের কাছে উপস্থাপন করতে পারছি না। বর্তমান সময়ে ইসলামী আদর্শ প্রচারে এটাই সবচেয়ে বড় বাধা।