অতিসম্প্রতি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে দেখা যায় বিভিন্ন ইসলামী বক্তা ওয়াজের ময়দানে একে অপরকে তুলাধুনা ধরেছে। শরীয়তের নির্ধারিত ফরজ ওয়াজিব বিষয় নিয়ে এসব বিতর্ক হয় না। বিতর্ক ও মতবিরোধ হচ্ছে ছোটখাটো কিছু আপেক্ষিক কথাবার্তা নিয়ে। যেমন আমাদের নবী হযরত মুহাম্মদ (সঃ) কিসের তৈরি মাটির না নূরের, কেউ বলছে হায়াতুন্নবী, আমার নবী জিন্দা আছেন, কেউ বলছে নবী আমাদের মতো মানুষ। এখন শুরু হয়েছে আমাদের প্রিয় নবী মুহাম্মদ (সঃ) নবুওয়াত কবে পেয়েছেন। কেউ বলছেন ৪০ বছর বয়সে আবার কেউ বলছেন আদম (আঃ) সৃষ্টির আগেই উনি নবী ছিলেন। এটা নিয়ে একে অপরকে ঘায়েল করা,কাফের ফতোয়া দেওয়া, এমনকি বিষয়টি আদালত পর্যন্ত গড়িয়েছে। অতি ছোটখাট মতপার্থক্য নিয়ে এমনিতেই মুসলিম সমাজে চারটি মাজহাব আছে, এরপর আবারও মতপার্থক্য নিয়ে লা মাজহাবি আছে, কেউ আহলে-হাদিসের অনুসারী, আবার কেউ নিজেদেরকে সালাফী-মানহাজ বলেও দাবি করেন। এভাবে একই নবীর উম্মতেরা মতপার্থক্য এবং মতবিরোধের পাল্লায় পড়ে ভিন্ন-ভিন্ন সম্প্রদায়,দল-উপদল গঠন করে দুর্বল থেকে অতি দুর্বল হয়ে যায়।
দ্বীন ইসলামের প্রকৃত শক্তি-সামর্থ্য ঐক্যবদ্ধ ইসলামী সমাজে প্রস্ফুটিত হয়। ঐক্যবদ্ধ ইসলামী সমাজে কিরূপ শক্তি আছে তা মুতা, ইয়ারমুক, আইনজালুত ও মান্জিকাটের ময়দানে আজকের ইউরোপিয়ানদের পূর্ব পুরুষরা হাড়ে-হাড়ে টের পেয়েছিল। ইউরোপীয় ক্রুসেডারেরা সর্বশক্তি নিয়োগ করেও মুসলিমদের অগ্রাভিযান থামাতে পারেনি। একের পর এক যুদ্ধে ক্রুসেডারদেরকে পরাজিত করে মুসলিমরা এগিয়ে যায়, নিকোপলিসের যুদ্ধ-১৩৯৬, কসোভোর যুদ্ধ -১৩৭৯, ভার্নার যুদ্ধ –১৪৪৪, কনস্টান্টিনোপালন বিজয়-১৪৫৩, চাল ডিনারের যুদ্ধ- ১৫১৪, বেলগেট অবরোধ -১৫২১ ,রোডস অবরোধ -১৫২২, মোহাকাচের যুদ্ধ-১৫২৬সালে। এরূপ আরও অনেক বড়-বড় যুদ্ধক্ষেত্রে সম্মিলিত ইউরোপে রাজারা নাস্তানাবুদ হয়েছিলেন। ইউরোপিয়ানরা সম্মিলিত আক্রমণ করেছিল বটে কিন্তু তারা ঐক্যবদ্ধ হতে পারেনি। ইউরোপীয় রাজা, সেনাপতি, নাইট ও সৈনিকরা পরস্পর বনিইয়ানুম মারসুছ গঠন করতে পারিনি। অপরপক্ষে মুসলিমদের জয়ের ভিত্তি ছিল পরস্পরের কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে শিশা-ঢালা প্রাচীর গঠন করা। একারণে আমেরিকা আবিষ্কারের পর ইউরোপীয় খ্রিস্টানরা পালাতে পালাতে আমেরিকার ভূখণ্ডে গিয়া স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলেছিল। ইউরোপ-আমেরিকা তখন ওসমানী খেলাফতের সামনে নস্যিমাত্র।
আমরা অনেকেই ইউরোপকে প্রশ্ন করতে সাহস পাইনা তোমাদের অঞ্চলে এত মুসলিম দেশ কিভাবে প্রতিষ্ঠা হলো। তোমাদের পূর্বপুরুষেরা নাকে-তেল দিয়ে ঘুমিয়েছিল নাকি প্রাণভয়ে পালিয়েছিল। আমরা অনেকেই জানিনা ইউরোপে মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ কয়টি দেশ আছে। মোট জনসংখ্যার অবস্থান হিসেবে তুরস্ক-৯৯%, নর্দান-সাইপ্রাস-৯৮%, কসভো-৯৬%, আলবেনিয়া -৫৬%, বসনিয়া-হার্জেগোভেনিয়া-৫১%,নর্থ-মেসিডোনিয়া-৩৩%,মন্টিনেগ্রো-২০% মুসলিম বসবাস করে। আধুনিক ইউরোপীয়ানরা মুসলিমদের শক্তি ও সামর্থ্য সম্পর্কে যতটা অবগত, দুঃখজনক হলেও সত্য মুসলিম জাতি ততটা অবগত নয়। এর প্রধান কারণ হলো মুসলিম জাতির নেতৃবৃন্দের ইসলামের সঠিক ইতিহাস সম্পর্কে অজ্ঞতা। মুসলিম জাতি তাদের পূর্বপুরুষদেরকে ভুলে গেলেও ইউরোপীয় খ্রিস্টানরা তাদের পূর্বপুরুষদের শত্রুকে ভুলে যায়নি। তারা ভুলে যায়নি তাদের পূর্বপুরুষরা কাদের হাতে নাকানিচুবানী খেয়েছিল।
ব্রিটিশরা উপমহাদেশের মুসলিমদেরকে টার্গেট করে বাংলার শেষ স্বাধীন নবাবকে ষড়যন্ত্রের জালে আটকে ১৭৫৭সালে ক্ষমতা কেড়ে নেয়, এরপর ১৮৫৭সালে মুঘল সম্রাটের নিকট থেকে ক্ষমতা কেড়ে নিয়ে সর্বশেষ মুঘল সম্রাটকে বার্মায় নির্বাসনে পাঠায়। তাহলে ইতিহাসের ধারাবাহিকতায় ১৯৪৭সালে ব্রিটিশরা চলে যাওয়ার সময় উপমহাদেশের ক্ষমতা এককভাবে মুসলিমদের হাতে ন্যাস্ত হওয়ার কথা। কিন্তু ইউরোপিয়ানরা তা করেনি, কারণ তারা ইতিহাস পড়ে, তারা জানে মুসলিমদের শক্তি। যদিও ছলচাতুরি করে মুসলিমদের নিকট থেকে ক্ষমতা কেড়ে নিয়েছিল কিন্তু এদেশ থেকে চলে যাওয়ার সময় তারা মুসলিমদের হাতে এদেশের মোট আয়তনের ২৪% অংশের ক্ষমতা প্রদান করেছিল, তাও আবার পূর্ব-পশ্চিমে দুই অংশে খন্ডিত মাঝখানে ১০০০মাইল ভারত-৭৬% বিশাল আয়তন নিয়ে গঠিত । এই নীতি-নৈতিকতা বিরোধী কাজ ব্রিটিশরা কেন করেছিল জানেন—ভবিষ্যতে উপমহাদেশের মুসলিমরা যাতে সোজা হয়ে দাঁড়াতে না পারে। আমাদের পূর্বপুরুষরা তাদেরকে বারবার পরাজিত করেছে, সেদিনগুলো আবারো ফিরিয়ে আনা সম্ভব যদি মুসলিমরা একতাবদ্ধ হতে পারে।
আজ প্রতিটি মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশে রাজনৈতিক অস্থিরতা, দলীয় কোন্দল, গৃহযুদ্ধ, হানাহানি কাটাকাটির প্রকৃত কারণ কি? সে সম্পর্কে কি বাস্তব ধারণা আছে? এর অন্যতম কারণ হলো মুসলিমরা যাদেরকে বন্ধু মনে করে প্রকৃতপক্ষেই তারা কিন্তু মুসলিমদেরকে জাতশত্রু মনে করে। কারণ তারা ইতিহাস অনুসরণ করে। ইউরোপ আমেরিকা তাদের পূর্বপুরুষদের পরাজয় আজও মেনে নিতে পারেনি। নতুন করে মুসলিম দেশগুলি সুসংগঠিত হবে, রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা কায়েম থাকবে, অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি আসবে, শিল্পায়ন হবে, সামরিক শক্তিতে টগবগ করে ফুটবে, একতাবদ্ধ হবে মানে বনিইয়ানুম মারসুছ, তাহলে কি হবে –সেটা মুসলিম জাতির কর্ণধাররা না বুঝলেও পরাশক্তিগুলো ভালোভাবেই বুঝে। তাইতো ইসলামবিরোধী চক্রের প্রধান এজেন্ডা হল যেমন করেই হোক মুসলিমদের মাঝে মতপার্থক্য এবং মতবিরোধ ঢুকিয়ে দাও, ওদেরকে দ্বিধা বিভক্ত করো, ওদের মাঝে দলীয় উপদলীয় কোন্দল সৃষ্টি করে দাও। আর এই কোন্দল সৃষ্টির অন্যতম উপায় হল দ্বীন-ইসলামের অতি ন্যূনতম বিষয়সমূহ, শরীয়তের দৃষ্টিকোণ থেকে, আমলের দৃষ্টিকোণ থেকে, ঈমানের দৃষ্টিকোণ থেকে যার কোন প্রভাব প্রতিক্রিয়া নেই। বোকা মুসলিম জাতির বিবেক আলেমগন এই সকল তুচ্ছ বিষয় নিয়ে মতপার্থক্য ও মতবিরোধ করে ইসলামবিরোধী শক্তির দাবারগুটি হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে, যা সত্যিই দুঃখজনক, লজ্জা জনক।
ওলামায়ে-কেরাম মসজিদের মেম্বারে উঠলে কিংবা ওয়াজের স্টেজে আসন পেলে মনে হয় নব্যুয়ত পেয়ে গেছেন (আস্তাগফিরুল্লাহ) । নিজেদেরকে ওহীপ্রাপ্ত নির্ভুল মনে করে অন্যদেরকে মূর্খ জাহেল এমনকি কাফের ফাসেক ফতোয়া দিয়ে দেন। মিথ্যা অপবাদ, গীবত, কূ- ধারনা, অনর্থক সমালোচনা ওলামায়ে-কেরামের নেশা ও পেশায় পরিণত হয়েছে। ওলামায়ে-কেরামের এমন অধঃপতনের পিছনে কে কলকাটি নাড়ে তা কিন্তু উনারা নিজেরাও জানেন না। কিংবা বলা চলে হুজুগে বাঙাল। চিলে কান নিয়েছে শুনে, নিজের কান যথাস্থানে আছে কিনা পরখ না করেই চিলের পিছে ছুঁটা শুরু হয়ে গেল। কে একজন বলেছে ওদের আকিদা খারাপ, উনি সাহাবী বিদ্বেষী,— আর হয়ে গেল। । ওই সব বিষয়ে বিস্তারিত খবর নেওয়া হয় না, পড়াশুনা করা হয় না, ওদের সম্পর্কে যা শুনেছি বাস্তবে তাঁরা সেরকম কিনা পরীক্ষা করে দেখি না। শুনেছেন ভুল তাফসীর করেছেন, ভুল লেখা লিখেছেন, কিন্তু কি কি ভুল লিখেছেন, কোথায় কোন ভুল তাফসীর করেছেন, সেটা তার লেখনী পড়ে প্রমাণ না করেই ফতোয়া দিয়েই মতপার্থক্য মতবিরোধ শুরু করে দিলো। ঠিক যেমন ঢাল নেই তলোয়ার নেই, নাম সোলায়মান গাজী। ইসলামপ্রিয় ব্যক্তিত্ব এবং দলগুলোর মধ্যে এভাবেই মতবিরোধ শুরু হয়ে যায়।
মুসলিম সমাজে এভাবেই মতপার্থক্য মতবিরোধের ফলে ফেতনা সৃষ্টি হয়ে যায়। রাজনৈতিক অস্থিরতা গৃহযুদ্ধ মুসলিম রাষ্ট্র সমূহ প্রশ্চাত পদতার অন্যতম উপাদান। এ কারণে পবিত্র কোরআনে মুসলিম সমাজের ফেতনা সৃষ্টি কারা হত্যাযোগ্য অপরাধ বলে গণ্য করা হয়। উলামায়ে কেরামের মতবিরোধ ও মতপার্থক্যের কারণেই মুসলিম সমাজ ঐক্যবদ্ধ কোন সিদ্ধান্তে উপনীত হতে পারছে না বলেই মুসলিম রাষ্ট্রসমূহের রাষ্ট্রপ্রধানরা নিজের জনগণের প্রতি দায়বদ্ধ নাহয়ে ক্ষমতাকে পাকাপোক্ত করার জন্য ইসলামবিরোধী পরাশক্তির আশ্রয় নিচ্ছে। আজকে যে সমস্ত ওলামায়ে-কেরাম সামান্য ছোটখাটো বিষয় নিয়ে নতুন করে মুসলিম ভ্রাতৃত্বের মধ্যে ফেতনা সৃষ্টি করতেছেন তাদের বিষয়ে শরীয়তের হুকুম কি আপনারা একটু ভেবে দেখবেন। আপনাদের একটা আজগুবি গল্প, আক্রমনাত্মক অঙ্গভঙ্গি, মিথ্যা অপবাদ এবং নিজের মতামত বা বিদ্যার উপর গোঁ ধরে থাকা মুসলিম উম্মাকে কতবছর পিছিয়ে দিচ্ছে, অন্যদিকে ভিন্নধর্মীদের কাছে হাসির খোরাক হচ্ছেন। মুসলিম জাতির ঐক্য বিনষ্ট করা ক্রসেডারদের প্রধান লক্ষ,সেটাও সফল।
আমরা ইতিহাস জানিনা, নিজেরা শিক্ষা নিচ্ছি না, অন্যদেরকেও শিক্ষা নেওয়ার সুযোগ দিচ্ছি না। আমরা নিজ হাতে নিজের গৃহে আগুন লাগাচ্ছি। কেউ সর্বস্বান্ত হচ্ছে, কেউ ঘর পোড়া আগুনের উষ্ণতা উপভোগ করছে। হায় আফসোস প্রায় শতবর্ষ যাবত ওলামায়ে-কেরাম ছোট-খাটো বিষয়ে মতপার্থক্য ও মতবিরোধে সময় নষ্ট করছেন, ইসলামবিরোধী জোট এর ফায়দা গ্রহণ করছে। মুসলিম দেশগুলোতে রাজনৈতিক অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা তো দূরের কথা নতুন-নতুন গোলযোগ সৃষ্টি হচ্ছে, শাসকেরা ক্ষমতা টিকিয়ে রাখতে এতই অস্থির যে সকল মুসলিম রাষ্ট্র ঐক্যবদ্ধ হয়ে সম্মিলিতভাবে ইসলাম বিরোধী শক্তির মোকাবেলা করতে পারছেনা, ফলে নির্দ্বিধায় পরাশক্তিগুলো সফলতার দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। কারণ তারা মুসলিম জাতিসত্তাকে ধ্বংশের ষড়যন্ত্র করলেও মূলত সে ষড়যন্ত্র বাস্তবায়ন হচ্ছে মুসলিমদের হাতেই। ওলামায়ে-কেরাম জাতির বিবেক, জাতিকে সঠিক পথনির্দেশ করে, দলমত নির্বিশেষে সকলকে দ্বীনের বিজয়ের জন্য ঐক্যবদ্ধ রাখা তাঁদের প্রধান দ্বায়িত্ব। এর অপারগতা ওলামায়ে-কেরামকে আদালতে-আখেরাতে আসামীর কাঠগড়ায় দাঁড় করাবে ।