শতবর্ষব্যাপি ফিলিস্তিনের আরব মুসলিমদের তিন প্রজন্মকে উদ্বাস্ত বানিয়ে গাজা এবং পশ্চিম তীরে চতুর্থ প্রজন্মকে ঝাঁকি জাল বা খ্যাপ জাল দিয়ে আবদ্ধ করে ফেলেছে। ঝাঁকি জাল বা খ্যপ-জালের ভিতরে মাছ যেভাবে আটকানো হয়, ঠিক তেমন ভাবে আটকে ফেলা হয়েছে অসহায় নারী পুরুষ শিশু বৃদ্ধকে, তাদেরকে খাদ্য পানি ঔষধ দেওয়ার কোন সুযোগ নেই। সমস্ত গাজাকে ধ্বংসস্তূপে পরিণত করার পর হাসপাতলে রোগী ও তাদের স্বজনেরা যখন বেঁচে থাকার সর্বশেষ চেষ্টা করে যাচ্ছিল, ঠিক সেই মুহূর্তে ইতিহাসের সর্ববৃহৎ নারকীয় ঘটনা ঘটে। হাসপাতালের উপর বোমা বর্ষণ করে, হাসপাতালের বেডে শুয়ে থাকা রোগী ও তাদের স্বজনসহ পাঁচ শতাধিক ফিলিস্তিনীকে হত্যা করে। হাসপাতালের মেঝেতে বোমায় ক্ষত-বিক্ষত নারী শিশু বৃদ্ধ ও যুবকের রক্ত একত্রে মিশে যাচ্ছে । তারপরও পশ্চিমা জগতের বড় দাদারা এই গণহত্যা ও যুদ্ধাপরাধ মূলক কর্মকাণ্ডকে সমর্থন দিয়ে সাহায্য করছে। ইহুদী জবরদখলকারীদের মানবিক অধিকার আছে কারণ তারা মানুষ !
আর ফিলিস্তিনের মুসলিমদের মানবিক অধিকার নেই, কারণ তারা মানুষ নয়! নয় কোন প্রাণী, জীবজন্তুর প্রতিও মানুষের দয়া মায়া থাকে। মুসলিমদের এক্ষেত্রে সেটাও নেই, ফিলিস্তিনিদেরকে তারা হয়তো জড় পদার্থ মনে করছে। তাদেরকে ইট-পাথরের মত সড়িয়ে দিয়ে ইহুদি রাষ্ট্র কায়েম করার এ স্বপ্ন একদিনে পূরণ হয়নি। প্রথম বিশ্বযুদ্ধ শুরু হওয়ার প্রায় একশত বছর আগে থেকে অভিশপ্ত ইহুদীরা ষড়যন্ত্র শুরু করে। বিংশ শতকের শুরুর দিকেই তাদের ষড়যন্ত্রের ফল আসতে শুরু করে।
পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে বসবাসকারী মুসলিম উম্মার জন্য মধ্যপ্রাচ্যের ঐ ফিলিস্তিনের নারী শিশু বৃদ্ধ ও যুবকের কান্না শেষ কান্না নয়। আরো অনেক ফিলিস্তিনের পদধ্বনি শোনা যাচ্ছে। বিশেষ করে ভারতীয় উপমহাদেশের বঙ্গোপসাগরে কোল ঘেসে শতকরা ৯০ জন মুসলিমের দেশে বসে সেই পদধ্বনি কানে কানে প্রতিধ্বনি হচ্ছে। কিন্তু নির্বোধ মুসলিমরা সে পদধবনি অনুভব করতে পারছেনা। আমাদের প্রতিবেশী দেশ ভারতের উত্তর-পূর্ব অঞ্চলের রাজ্য মিজোরাম। ২০১১ সালের আদমশুমারী অনুসারে মিজোরামের বিভিন্ন গোষ্ঠীর মধ্যে সংখ্যাগরিষ্ঠ (৮৭%) মিজো খৃস্টান ধর্মালম্বী, বাকি জনসংখ্যার ৮.৩% বৌদ্ধ, ৩.৬% হিন্দু ধর্মালম্বী। কয়েক হাজার নৃতাত্ত্বিক মিজো রয়েছে যারা ইহুদি ধর্মে বিশ্বাসী। এছাড়া ভারতের বিভিন্ন প্রদেশে প্রচুর পরিমাণ ইহুদি ব্যবসায়ী শিল্পপতি বসবাস করে। আরেকটি উল্লেখযোগ্য ঘটনা হলো যে কোন মানুষ যেকোনো ধর্মমত গ্রহণ করতে পারে কিন্তু যে কোন মানুষ ইহুদী ধর্ম গ্রহণ করতে পারেনা। ইহুদি ধর্মমতে শুধুমাত্র বনী ইসরাইলের সন্তানরাই ইহুদি হওয়ার যোগ্যতা রাখে। তাহলে প্রশ্ন আসতে পারে ভারতীয় উপমহাদেশের পার্বত্য অঞ্চলে নৃতাত্ত্বিক জনগোষ্ঠীর মধ্যে বনী ইসরাইলের বংশধরদের আগমন হলো কিভাবে? নিশ্চিত ভাবে বলা যায় ফিলিস্তিনের মত দখলদারিত্ব কায়েমের উদ্দেশ্যে তাদেরকে পরিকল্পিতভাবে কয়েকশো বছর আগে পাঠানো হয়েছে।
“১৮৯২ সালের জানুয়ারি মাসে তদানীন্তন ব্রিটিশ ইন্ডিয়ার রাজধানী কলকাতায় বাংলার ছোটলাট লেফটেন্যান্ট গভর্নর, স্যার চার্লস আলফ্রেড এলিয়টের সভাপতিত্বে একটি খুব গুরুত্বপূর্ণ সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়েছিল। এই সম্মেলনের প্রধান উদ্দেশ্য ছিল বাংলা, আসাম আর বার্মার সীমান্ত ঘেঁষা চিন-লুশাই হিলসের প্রশাসনিক রূপরেখা নির্ণয় করা। ওই অঞ্চলে বসবাসকারী কুকি-চিন-লুশাই ( কুকি-চিন-মিজো বলেও অনেকে চেনেন) যাদেরকে ব্রিটিশরা সহজেই বাগে আনতে পারছিল না। কলকাতার সেই ‘চিন-লুশাই কনফারেন্সে’র পরই স্থির হয়েছিল, এই জাতিগোষ্ঠীর বাস যে বিস্তীর্ণ এলাকা জুড়ে তা তিনটি ভাগে ভাগ করে দেওয়া হবে – চিন হিলস বার্মার, লুশাই হিলসের দক্ষিণভাগ বাংলার আর উত্তরভাগ আসামের নিয়ন্ত্রণে থাকবে। ফলে যে কুকি, চিন ও লুশাইরা নিজেদের একই উপ-জাতি, একই সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের লোক বলে মনে করেন,তা বিচ্ছিন্ন হয়ে যাবে। ব্রিটিশ কর্তৃক তাদের মধ্যে সীমান্তের বিভেদ তৈরি করা হয়েছে সেই এক’শ ত্রিশ বছরেরও বেশি আগে। সীমান্ত বিভেদ তৈরি হলেও তাদের জাতিসত্তা, সংস্কৃতি, কৃষ্টি কালচারে বিবেদ সৃষ্টি করতে পারেনি”। (তথ্যসূত্র–বিবিসি বাংলা, দিল্লি, শুভজ্যোতি ঘোষ,৫ই জুলাই/২০২৩ইং)
কুকি, চিন ও লুশাই (মিজো) ব্রিটিশ কর্তৃক বিভক্ত হয়ে ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চল জুড়ে, মিয়ানমারের উত্তর-পশ্চিমাংশে এবং বাংলাদেশের পার্বত্য চট্টগ্রাম এলাকা জুড়ে বসবাস করে। এই তিন দেশের সীমান্ত অঞ্চলের বসবাসকৃত ঐসকল উপজাতি ভাষা সংস্কৃতি কৃষ্টি-কালচার এক হওয়ার কারণে তাদের মাঝে আভ্যন্তরীণ যোগসূত্র স্থাপিত হয়। উপজাতি নৃতাত্ত্বিক জনগোষ্ঠী দেশ-বিভিন্ন হলেও তাদের মাঝে আভ্যন্তরিন যোগাযোগ থাকলেও আমাদের মাথা ব্যাথার কারণ হতো না। কিন্তু আজ অবস্থা এমন হয়েছে যে শুধু মাথাব্যথা নয়, আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্মের ঘাড়ে মাথা থাকবে কিনা সেটাই বড় প্রশ্ন হয়ে দেখা দিয়েছে।
২০১৭ সালে ঢাকা ইউনিভার্সিটির চারুকলা বিভাগের ছাত্র নাথান বম কর্তৃক কুকি-চিন ন্যাশনাল ফ্রন্ট (কেএনএফ), বা বম পার্টি প্রতিষ্ঠিত হয়। “কুকি-চিন ন্যাশনাল ফ্রন্ট (কেএনএফ),–যা কিনা পার্বত্য চট্টগ্রামে অবস্থিত বাংলাদেশের একটি নিষিদ্ধ বিচ্ছিন্নতাবাদী রাজনৈতিক সংগঠন। কেএনএফ রাঙামাটি এবং বান্দরবান জেলার নয়টি উপজেলা নিয়ে বম (কুকি-চিন- মিজো) জনগণের জন্য একটি পৃথক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করতে চায়। বাংলাদেশের আইন প্রয়োগকারী সংস্থার মতে, কুকি-চিন ন্যাশনাল ফ্রন্ট মিয়ানমারের কাচিন রাজ্য থেকে অস্ত্র পেয়েছে, এবং কারেন বিদ্রোহীর সাথেও এর সম্পর্ক রয়েছে। এর সশস্ত্র শাখার নাম কুকি-চিন ন্যাশনাল আর্মি (কেএনএ)।
২০২২ সালের অক্টোবরে কুকি-চিন ন্যাশনাল আর্মির বিরুদ্ধে বাংলাদেশ সেনাবাহিনী ও অন্যান্য নিরাপত্তা বাহিনীর অভিযানের প্রস্তুতি হিসেবে বান্দরবান জেলা থেকে পর্যটকদের ফেরত পাঠানো হয়। ২০২২ সালের নভেম্বরে, বাংলাদেশ সেনাবাহিনী কুকি-চিন ন্যাশনাল আর্মির বিরুদ্ধে একটি অভিযান শুরু করে, যার ফলে ২৭০ জন কুকি উপজাতি ভারতের মিজোরামে আশ্রয় নেয: ।(Dhaka tribune।, vThe Daily Star , 09–02—2023 ,bdnews 24 .com , www.dhakatribune.com 21-03-2023,)
এখন প্রশ্ন আসে, ব্রিটিশ শাসক কর্তৃক প্রশাসনিক বিভেদ সৃষ্টি করার পর ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর অধিবাসী সমূহ ভারত, বাংলাদেশ ও মায়ানমার অঞ্চলে তিনটি দেশে বিভক্ত হয়ে সুখে শান্তিতে বসবাস করুক এটাই সকলের প্রত্যাশা। কিন্তু বড় সমস্যা হলো দিনে দিনে এই নৃগোষ্ঠী সম্প্রদায় শক্তি সঞ্চয় করে স্বাধীন আবাস ভূমি দাবি করে বসে,তাও আবার ক্ষুদ্র আয়োতনের বাংলাদেশ ভূখণ্ডে।
আর একটা চিন্তার কারণ এই ব্রিটিশ শাসকেরা যেখানেই ভাগ করেছে সেখানেই সমস্যা সৃষ্টি হয়েছে। তারা ১৯৪৮ সালে ফিলিস্তিন ভূখণ্ডকে ইহুদি এবং মুসলিমদের জন্য দুই ভাগে বিভক্ত করে দিয়েছিল। ইহুদি রাষ্ট্র গঠন হয়েছে পশ্চিমারা স্বিকৃতি দিয়েছে, সাহায্য সহযোগিতা করছে কিন্তু ফিলিস্তিনের মুসলিমদের আলাদা রাষ্ট্রের স্বীকৃতি তো নেই, বরং তাদের পৈতৃক ভূমি থেকে উচ্ছেদ করা হচ্ছে। এখানে জোর যার মুল্লুক তার একথাই প্রযোজ্য হয়েছে। দখলদার ইহুদি গোষ্ঠী পাশ্চাত্যের খ্রিস্টান দেশসমূহ এবং বড় দাদার প্রত্যক্ষ মদদে ফিলিস্তিনের স্থায়ী অধিবাসীদেরকে ধীরে ধীরে উদ্বাস্ত বানিয়ে ফেলছে।
ফিলিস্তিনের এ সকল ঘটনা আমাদের জন্য অতি ভয়াবহ ভয়ের কারণ। বাস্তবেও দেখা যাচ্ছে, কুকি চীন মিজোর সম্মিলিত সংগঠন পাশের দুদেশের তুলনায় অতি ক্ষুদ্রদেশ বাংলাদেশের ভূখণ্ডে তাদের কাঙ্খিত স্বাধীন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করতে চাচ্ছে। কারণ তারা ভারতের কোন অঙ্গরাজ্যের জমি চাচ্ছেনা কারণ বৃহত্তর ভারত পারমানবিক অস্ত্রধারী দেশ, আবার মিয়ানমারের দিকেও হাত বাড়াচ্ছে না এই ভয়ে যে, বৌদ্ধ অধ্যুষিত মিয়ানমারের পাশে আরেক পারমাণবিক শক্তিধর বৌদ্ধ রাষ্ট্র গণচিণ রয়েছে। ওই দুই দিকে বিশেষ সুবিধা করা যাবে না, এক্ষেত্রে মুসলিম বিশ্ব থেকে বিচ্ছিন্ন দুর্বল অসহায় বাংলাদেশের ভূখণ্ডই তাদের বাঞ্ছিত সফলতা এনে দিতে পারে।
এই পরিস্থিতিতে ভারতের ত্রিপুরা রাজ্যের বিশিষ্ট সাংবাদিক প্রসেনজিৎ চক্রবর্তী এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রফেসর ডঃ নাজমুল হাসান করিমুল্লাহ সাহেবের কথা রাতের ঘুম কেড়ে নিয়েছে। তাদের দুজনের কথার মধ্যে হুবহু মিল রয়েছে, তাঁরা উভয়ই বলছেন ভারতের বিভিন্ন প্রদেশে যে সকল ইহুদি আছে বিশেষ করে মনিপুর এবং মিজোরাম অঞ্চলে যে ইহুদি আছে তারা”বনি মনাশে”নামক ইহুদি গোত্রের লোক । ইতিমধ্যেই “বনি মনাশে”রা ইহুদি রাষ্ট্রের সাথে যোগাযোগ করেছে, ইহুদি রাষ্ট্র ইজরাইল “বনি মনাশে” নৃগোষ্ঠীকে বনি ইসরায়েলের বংশধর ও ইহুদি ধর্মের অনুসারী হিসেবে স্বীকৃতি প্রদান সহ আভ্যন্তরীণ যোগাযোগ স্থাপিত হয়েছে। প্রকৃতপক্ষে কুকি ও মিজো উপজাতির সাথে মিশে থাকা বনি মনাশে গোত্রের ইহুদীদের নেতৃত্বে গড়ে উঠেছে রাজনৈতিক সংগঠন কুকি চিন ন্যাশনাল ফ্রন্ট ও তাদের সামরিক শাখা কুকি চিন ন্যাশনাল আর্মি। ইতিমধ্যেই বনি মনাশে ইহুদি সম্প্রদায়ের পাঁচ হাজার যুবক ইজরাইলের সেনাবাহিনীতে অন্তর্ভুক্ত হয়েছে এবং তারা বর্তমানে হামসের সাথে যুদ্ধে লিপ্ত আছে। আর একটা উল্লেখযোগ্য ঘটনা হলো, ইহুদি রাষ্ট্র ইজরাইলের সেনাবাহিনীর ইউনিফর্ম এবং কুকি-চিন ন্যাশনাল আর্মির ইউনিফর্ম যেমন একই, তেমনি কুকি-চিন ন্যাশনাল আর্মির পরিচালকের প্রধান ভূমিকা পালন করছে ইহুদি গোষ্ঠী “বনী মনাশে”। বনি মনাশে ইহুদি রাষ্ট্র ইসরাইলের বি- টিম হিসেবে আমাদের পার্বত্য চট্টগ্রামের সশস্ত্র অবস্থান নিয়েছে। পার্বত্য চট্টগ্রামে আজকে তাদের এই কার্যক্রম অতিসামান্য হলেও বিংশ শতকের প্রথম দিকে ফিলিস্তিনের ভূখণ্ডে ইহুদিদের আগমনের কথা স্মরণ করিয়ে দেয়।
আমরা মুসলিমরা কোন জটিল বিষয়ের প্রতি গুরুত্বসহকারে মনোযোগ দেই না, কেউ বলবেন– ও আমরা এটা জানি, কেউ বলবে আমি এটা শুনেছি, মুসলিমদের সংঘ OIC বলবে– হু–আমি দেখছি ! মুসলিমরা শুধু এটুকু বলাকে যথেষ্ট মনে করে। এরপর আসন্ন বিপদ থেকে জাতিকে উদ্ধার করার প্রস্তুতিমূলক কোন কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ না করেই স্রোতে গা ভাসিয়ে দেয়। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর ফিলিস্তিনের মাটিতে যখন দু চার-পাঁচটি করে ইহুদী বসতি স্থাপিত হয়েছিল তখন মধ্যপ্রাচ্যের মুসলিম সম্প্রদায় গুলো তেমন গুরুত্ব দেয়নি ঠিক যেমন পার্বত্য চট্টগ্রামের নেমে আসা আসন্ন বিপদ সম্পর্কে আমরা গুরুত্ব দিচ্ছি না। অদুর ভবিষ্যতে আরেক ফিলিস্তিনের পুনরাবৃত্তি পার্বত্য চট্টগ্রামের অঞ্চল থেকে শুরু হলে অবাক হওয়ার কিছুই থাকবে না। তখন আমাদের পরবর্তী প্রজন্মের আশ্রয় কোথায় হবে–এ চিন্তা এখনই করা প্রয়োজন।