ছেলেবেলার কথা, ৫মশ্রেনীতে পড়ি, ছেলেমেয়ে একত্রে দলবেঁধে স্কুলে যাতায়াত। স্কুলেরপথে একদিন একটা ঘটনাঘটে, আমাদের চেয়ে অনেক বড় দুটিছেলে ঝগড়া করছে। দুজনের মধ্যে অপেক্ষাকৃত হ্যাংলা-পাতলা ছেলেটি, মোটাসোটা ছেলেটিকে ফটাফট দু’চারটা মাইর দিয়ে দিল। মোটাসোটা ছেলেটি মাইর খেয়ে গোঁ-গোঁ করে বলে উঠলো,– আরেকটা মাইর দিয়ে দেখো,— কি করি। ব্যাস, ঠাস করে আরেকটা মাইর বসিয়ে দিল। এভাবেই বোকাটি মাইর খেয়ে যাচ্ছে আর বলছে,– আরেকটা মাইর দিয়ে দেখো,— কি করি। আমরা ছোট ছিলাম বিধায় খুব ভয় পেয়েছিলাম। মারামারি ঠেকানোর মতো বয়স বা সাহস কোনটি আমাদের ছিল না। হ্যাংলা পাতলা ছেলেটির হাতে মোটাসোটা ছেলেটি এত মাইর খেলো যে, তার চোখমুখ ফুলে রক্তবর্ন হয়েগেল, একপর্যায়ে মাটিতে পড়ে গোঙ্গাতে-গোঙ্গাতে বলতেই থাকলো—আরেকটা মাইর দিয়ে দেখো,— কি করি। ছলেবেলার নিজের চোখে দেখা সেঘটনা সাথে আজ জাতীয় জীবনের কতমিল, এটা ভেবে দুচোখের ঘুম হারাম, ছেলেবেলার মত অস্থিরতা চেপে বসেছে।
বেশিদিন আগের কথানয়, উপমহাদেশের মুসলিম শাসনামল, সুলতানি আমল, মুঘল আমল এমনকি নবাবী আমলেও বাংলাকে বলা হত বিদ্রোহী বাংলা। তাইতো ইংরেজরা এই বাংলাতেই রাজ্য বিস্তারে স্বপ্ন দেখার সুযোগ পেয়েছিল। আবার এই বাংলা থেকেই ইংরেজ খেদানোর আন্দোলন্ও শুরু হয়েছিল। আন্দোলনের সুতিকাগার বাংলার সন্তান বলে আমরা গর্বিত ছিলাম । কিন্তু আজ এমন এক জাতীয় জীবনে প্রবেশ করেছি যে আমরা বাংলার সন্তান, এটা বলতেই যেন লজ্জা লাগছে।
ব্রিটিশরা চলে গেল, পাকিস্তানিদেরকে জোর করে বের করে দেওয়া হলো। আমরা আশ্বস্ত হলাম এবার পুরোপুরি সার্বভৌমত্ব পেলাম। কিন্তু অচিরেই দেখা গেল –ধান ফুরালো, পান ফুরালো, বর্গীরা ধেয়ে আসলো। এ যেমন-তেমন বর্গী নয়। কাবলিওয়ালার চেয়েও অনেক বড়ঝোলা। একটা একটা করে জাতির পিঠে ঘা মারছে, আর একটা একটা করে জিনিস ঝোলার ভেতরে ভরছে, আর জাতির বিবেক শুধু বলেই যাচ্ছে আরেকটা মাইর দিয়ে দেখ, আরেকটা জিনিস নিয়ে দেখো,– কি করি!
নতুন কাবলিওয়ালা যখন ঝোলা নিয়ে আমাদের সীমানায় ঘোরাফেরা করছিল তখন দেশের কিছু সূর্যসন্তান তার মনেরভাব বুঝতে পারে। ঝোলার সাইজ দেখে তারা বুঝতে পেরেছিল সুযোগ পেলে দেশটাকে ঝোলার ভিতরে ঢুকিয়ে নেবে, তাইতো তারা জীবন-মরনপণ করে বাধা দিয়েছিলো। কারণ ওরাতো একটা মাইর দিয়ে দেখো,– কি করি, এমন জাতের ছিলনা। ওদেরকে একটা কিলদিলে ওরা ১৮টা ঘুসি মেরে বসত। ওরা ছিল লড়াকু, ওদের রক্তে ছিল আভিজাত্য, তাইতো এই অপরাধের শাস্তি ওদেরকে দেয়া হয়েছে। বিদ্রোহের নাম করে একদিনে এদেশের ৬৮জন সূর্যসন্তানকে হত্যা করে পথের-কাঁটা দূর করা হয়। তারপরও নির্বাক জাতি বলে– আরেকবার বিদ্রোহের নাটক করে দেখো,— কি করি!
ওরা ঝোলা ভর্তিপণ্য নিয়ে এসে ঝোলা ভর্তিটাকা নিয়ে যাচ্ছে, কিন্তু আমাদের পণ্য তাদের দেশে যেতে দেয়না। ওরা ট্যাক্সফ্রি বন্দর টোলফ্রি রাস্তা ব্যাবহার করছে, কাবলিওয়ালার ডিঙ্গি-নৌকার সাইজ পায়ের পাতার ভারে আমাদের পলিমাটির রাস্তা ভেঙ্গেচুরে একাকার। কাবলিওয়ালা মাথায় হাত বুলিয়ে বলল কুচপরোয়া নেহি। আমি টাকা ধারদিচ্ছি রাস্তা ঠিককরে নাও পরে সুদসহ শোধ করিও। আমাদের বড়বড় ইঞ্জিনিয়ার, ঠিকাদার, ব্যবসায়ীরা দেখছে নিজেরাও ছিঁটে ফোঁটা যা পায় তাই চেটেচুটে খায়, আর বলে আরেকবার রাস্তাঘাট ভেঙ্গে দেখাও, তখন বুঝবে কি করি!
কাবলিওয়ালার ঝোলা থেকে নিত্য নতুন সওদা বের হতে লাগলো। শেরওয়ানিপড়া শিক্ষাব্যবস্থাকে নেংটিতে নামিয়ে দিল। হাতে-কলমে শিক্ষা, আধুনিকতা ও প্রগতির নামে আমাদের প্রকৃত শিক্ষানীতিকে দূরে সরিয়ে দিল। দিনের পর দিন ইতিহাসের বিকৃতি ঘটাতেই থাকলো। ৯০% মুসলিমের দেশে নারীর হিজাব নিয়ে কথা উঠলো, বিধর্মীয় কর্মকর্তাদের হাতে ধর্মীয়শিক্ষার দায়িত্ব দিলো, আলেম-ওলামাদের সমাবেশে বিধর্মীকে প্রধানঅতিথি করে তালিম দিল, যারা প্রতিবাদ করল তাদেরকে ষড়যন্ত্রের ফাঁদেফেলে নাস্তানাবুদ করেদিল। তারপরও এদেশের হাজার হাজার দ্বীনি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের লক্ষ লক্ষ ছাত্র শিক্ষক, হাফেজ মাওলানা মুফতি হাদিস বিশারদ সবাই কেমন যেন বলতে থাকলো, আরেকবার অমন করে দেখো, –কি করি!
হায়রে মুসলিম দেশ, পাড়ায় পাড়ায় মসজিদ, মাদ্রাসা, তারাবির নামাজের কত মহড়া, কত দামি টাইলস লাগিয়েছে, কত টনের কয়টা এসি লাগিয়েছে, এসব বিষয় ভাবলে নাকি ইমান-আমলের ফয়দা হয়। কিন্তু সেই দেশে যখন ইফতার মাহফিলকে নিষিদ্ধ করে, কুরআন পাঠের আসর বন্ধকরে, বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গনে ইস্তিখারার নামাজের অনুমতি দেয়না। ধর্মশিক্ষাকে সিলেবাস থেকে বাদ দেওয়া হয়। তখন আর ঈমান-আমল প্রকাশ পায়না, মুখে কুলুপএঁটে বসে থাকে। ত্রিশূল বিতরণ, গুরুদুয়ারা থেকে তরবারি নিয়ে মিছিলে যুদ্ধের মহড়া,এসব কিছু আমাদের সহ্য হয়েগেছে। পূর্বপুরুষদের শৌর্যবীর্য যাই থাকনা কেন, আমরা সংযমের ব্রতনিয়েছি। পিটিয়ে হাফেজ যুবকে হত্যা করলেও আমরা সংযমী, প্রতিবাদ না করেও বলি, আরেকদিন,আরেকবার অমন করলে, –দেখিও কি করি!
দেশের প্রশাসন, আইন-শৃঙ্খলা, নিরাপত্তা, বিচার,অধিদপ্তর, কর্পোরেশন, ব্যাংক-বীমা সর্বত্র একই গুঞ্জন। কার প্রমোশন হবে, কে ওএসডি হবে, কার চাকরি থাকবেনা এ সবকিছু ঝোলা থেকে নিয়ন্ত্রণ হচ্ছে। অধিদপ্তরের চীফ ইঞ্জিনিয়ার, মন্ত্রণালয়ের সচিব, যুগ্ন সচিব, কিংবা বিচারপতির পদ পাওয়ার জন্য নাকি কেউ কেউ কাবলিওয়ালার ঝোলার যত্ন করে থাকেন। উড়ে এসে জুড়ে বসলো, একটার পর একটা অর্ডার পাস করালো, প্রমোশন, বদলি, ওএইচডি ,চাকরিচ্যুতো, নিজ এজেন্টদের নিয়োগ আরো কত দাপট! আমাদের স্বাধীন দেশের দেশপ্রেমিক কর্মকর্তারা বলতেই থাকলো —আরেকটা অর্ডার পাশ করে দেখাও,— দেখবে কি করি!
কাবুলিওয়ালার সাহস বেড়েই চলল, আঁটসাঁট বেঁধে আসল দিকে নজর দিল। নির্বাচিত জন-প্রতিনিধিদের মাধ্যমে নিরাপত্তা ও পূর্ণতা পাওয়া সম্ভব। তাইতো তারা তালিকা ধরিয়ে দিল এদেরকে প্রার্থী করতে হবে। তাইতো বাধ্য হয়ে অনেক ত্যাগী নিঃস্বার্থ সমাজকর্মীকে বাদ দিয়ে তাদের ফর্মুলা বাস্তবায়ন করা হলো। বিরাট সংখ্যক সেবাদাস ফুলেল শুভেচ্ছায় সুশোভিত হল, তাদেরই সিদ্ধান্ত অনুযায়ী পরিষদ সাজানো হলো যেন বিপক্ষে ভেটো দিতে নাপারে। দেশের রাজনৈতিক নেতাকর্মী, সুশীল সমাজ, সবকিছু স্বচক্ষে দেখতে পেল। তারা সকাল-বিকাল এরওর কল্লা দিয়ে নাস্তা করে, একে ধরো, ওকে ধরো, জবাই করো, কত নর্তন,কূর্দন। কিন্তু ঝোলার ব্যাপারে মুখে কুলুপ-আটা, সবাই মিঁউ মিঁউ করে বলে, আরেকবার ফর্মুলা দিয়ে দেখো, আরেকটা অডার করে দেখো, — কি করি!
ব্যবসা-বাণিজ্য, আমদানি রপ্তানি সবকিছু ঝোলার ভিতর ঢুকে গেল। দেশে উচ্চশিক্ষিত বেকারের সংখ্যা বাড়তে থাকলো, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা সমাপ্ত করে কেউ সবজি বিক্রি করে, কেউ রিক্সা চালায়। আর ঝোলার ভিতরের কর্মকর্তা-কর্মচারী দেশের প্রাইভেট সেক্টরে গিজগিজ করছে। এমনকোন মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানি খুঁজে পাওয়া যাবেনা যার সিইও,এফসিও পদে দেশীয় কেউ আছে। এমনকি গার্মেন্টস ফ্যাক্টরিতেও উল্লেখযোগ্য বড়বড় পদগুলো তাদের দখলে। ধর্মঘট, শ্রমিক আন্দোলন কিংবা অগ্নিকাণ্ড ঘটিয়ে বিলিয়ন বিলিয়ন ডলারের কাজ ভাগিয়ে নিয়ে যাচ্ছে, এ সবকিছু তাদের আঙ্গুলের তুড়ি মাত্র। আমাদের চেম্বার অফ কমার্স, বড়বড় শিল্পপতি, শ্রমিক সংগঠন সবকিছু দেখে শুনে, দিনশেষে বলে আরেকবার অমন অমন করে দেখো,— কি করি!
হায়রে বাংলার মুসলিম,পূর্বপুরুষরা আত্মরক্ষায় অভ্যস্ত ছিল। অন্যরা যখন পাতলাচটি পরতো, আমাদের পূর্বপুরুষরা তখন মোটা কাঠের খড়ম পরতো। খড়মের পিটুনীতে অনেক ভূত ভেগেযেত। আজ জুজুবুড়ির ভয়ে আমরা কাপছি, সত্যি যারা বাধা দিত, একটা কিলের বদলে ১৮টা ঘুঁসি বসিয়ে দিত, আর যাদের আহবানে টেকনাফ থেকে তেতুলিয়া রুপসা থেকে পাথুরিয়া সিসাঢালা প্রাচীরের মতো প্রতিরোধ তৈরি হতো তাদেরকে অপবাদ দিয়ে হত্যা করেছি। জাতিগতভাবে আমরা বিবেকহীন হয়েগেছি, দেশপ্রেমিকদেরকে নির্বিচারে গুম-খুন ও বন্দীকরাকে চাকুরি মনেকরি। সেবাদাস হওয়াকে দায়িত্ব পালন মনেকরি। জাতির ক্ষতিসাধন করে খাওয়াকে বুদ্ধিজীবী বলি। কে কতভাবে অন্যায়-অবিচার করে প্রমোশন পেল এসব ভাবছি, দেশের কথা কেউ ভাবছি না। প্রয়োজন ফুরিয়ে গেলে লেন্দুপ দর্জির মত অবস্থা হবে, এটা হয়তোবা এখন একটু-একটু করে বুঝতে পারছে। কিন্তু এখন বুঝেতো লাভনেই, খালকেটে কুমির এনেছেন, বর্তমানে খালেরপানির চেয়ে কুমিরের বাচ্চা বেশি হয়েগেছে। এত বাচ্চা খালে থাকবে কিকরে, হয়তোবা ইতি-মধ্যেই তারা দেশের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ সেক্টরে গিয়ে বসতে চাচ্ছে। এখন দিতে চাচ্ছেননা, ভাবছেন স্বাধীনতা এনেছি প্রকাশ্যে বিকিয়ে দেই কিকরে। কিন্তু কুমিরের বাচ্চা বড়হতে বেশিদিন সময় লাগেনা। এটা কারো ব্যক্তিগত বা দলীয় সমস্যা নয়, জাতীয় সমস্যা। ভুল ত্রুটি যা হয়েছে সেজন্য পিছনে দেখে লাভনেই। দেশবাসী সকলকে সাথে নিয়ে ঐক্যবদ্ধভাবে প্রতিরোধ প্রাচীর নির্মাণ করুন। কুমির তাড়ানোর ডাক দিয়ে দেখুন, যার যাকিছু আছে তাই নিয়ে জনগণ সাড়া দিবে। সময় এসেছে একটা কিলের পরিবর্তে ১৮টি ঘুসি মারার জন্য প্রস্তুত থাকার। মাইর খেতে খেতে দেয়ালে পিঠ ঠেকে যাওয়ার পরও যদি বলি– আরেকটা মাইর দিয়ে দেখো,— কি করি। তাহলে দাসত্বের শৃংখলে আবদ্ধ হওয়া সময়ের ব্যাপার মাত্র।