অরণ্যে রোদন

আদর্শিক যাত্রার শুরুতেই শিখেছি মূলধন সিন্দুকে আবদ্ধ করে রাখলে কোন লাভ নেই, মূলধন বাজারে বিনিয়োগ করে লাভবান হওয়ার মাঝেই সার্থকতা। কিন্তু আদর্শিক পথ চলার তিন যুগ পেরিয়ে আজ কেন জানিনা বুঝতে পারছি প্রকৃতপক্ষে আমরা আমাদের মূলধন সিন্দুকে আবদ্ধ হয়ে থাকছে, বিনিয়োগের যথা উপযুক্ত প্রচেষ্টা ও চিন্তা হয়েছে কিন্তু অনেক ক্ষেত্রে বাস্তব পদক্ষেপ নেয়া হয়নি কিংবা বিনিয়োগ করার চেয়ে সিন্দুকে আবদ্ধ রাখাই নিরাপদ মনে করেছি। এর পিছনে একটাই কারণ ‘পাছে লোকে কিছু বলে’ ।

আমার কথাগুলো “মায়ের কাছে মামা বাড়ির গল্প” বলার মত মনে হলেও বর্তমান সামাজিক প্রেক্ষাপটে ভেবে দেখা দরকার। কারণ প্রচলিত সমাজ ব্যবস্থাকে ভেঙ্গে আদর্শিত সমাজ প্রতিষ্ঠার কাজ যুগে যুগে হয়েছে। প্রাথমিক পর্যায়ে সকল যুগে আদর্শিক সমাজ প্রতিষ্ঠার কাজ যেভাবে শুরু হয়েছে, সে কর্মপদ্ধতির মূলনীতি থেকে সরে এসে, প্রতিষ্ঠিত আদর্শিক সমাজের রীতিনীতি নিয়ে আমরা আমাদের আধা পৌত্তলিক ধাঁচে গড়া সেকুলার সমাজকে পরিবর্তন করার চেষ্টা করে যাচ্ছি। ইতিহাসের দিনক্ষণ গুনে দেখা যায় আল্লাহর রাসূল মুহাম্মদ (সঃ) এর ইসলামী আন্দোলনে মক্কার জীবনে শরীয়তের অনেক গুরুত্বপূর্ণ বিধি-বিধান ফরজ করা হয়নি। যেমন মদ খাওয়া, পর্দা প্রথা, রোজা, যাকাত, দন্ডবিধি আইন ও সুদের লেনদেন। এরকম আরো অনেক গুরুত্বপূর্ণ বিষয় পাওয়া যাবে যেগুলো তদানীন্তন সময়ে সমাজের মধ্যে এত বেশি প্রচলিত ছিল যে, এ সব বিষয়কে নিষিদ্ধ ঘোষণা করে সমাজ পরিশুদ্ধির কাজ শুরু করাই সম্ভব ছিল না। ইসলামী সমাজ এবং রাষ্ট্র ব্যবস্থা কায়েমের শেষ পর্যায়ে এসে ওই সকল গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হারাম ঘোষিত হয়।

ভাবলে অবাক হতে হয় আমাদের দেশের দ্বীন কায়েমের আন্দোলনে তাকওয়া ও পরহেজকারী এত পরিমানে বেড়ে গিয়েছে যে—কিছু কিছু ক্ষেত্রে আমরা রাসূলুল্লাহ (সঃ) কিংবা সাহাবায়ে কেরামের আন্দোলনের চেয়েও বেশি অগ্রগামী হচ্ছি, না হলে ‘পাছে লোকে কিছু বলে’- এটা ভেবে জন্ম লগ্ন থেকে একই বৃত্তের মাঝে ঘুরপাক খাচ্ছি কেন? বিধি-নিষেধের রেখায় আঁকা বৃত্তের মাঝে আমাদের বসবাস। আমাদের বৃত্তের ভিতরটা সমাজ নয়, আমরা সমাজের ক্ষুদ্র একটা অংশ। আমাদের সংশোধনী কার্যক্রম বৃত্তের মাঝেই সীমাবদ্ধ থাকলে পুরা সমাজ সংশোধন হবে কিভাবে? পুরা সমাজটাকে সংশোধন করতে চাইলে সমাজের প্রচলিত নিয়ম-নীতি মেনেই সংশোধনের কাজ অব্যাহত রেখে আদর্শিক সমাজ গঠনের শেষ অধ্যায় এসে আদর্শিক রীতিনীতি প্রয়োগের চিন্তা করা উচিত।

রক্ত পানি করা শ্রমে প্রতিষ্ঠিত আমাদের স্কুল, কলেজ, ইউনিভার্সিটি, হাসপাতাল, ব্যাংক, বীমা অন্যরা দখল করে নিল। কিন্তু আমাদের প্রশিক্ষিত জনশক্তিকে বিনিয়োগ করে অন্যের প্রতিষ্ঠানকে নিজেদের দখলে নিতে পারছি না। এর অন্যতম কারণ মূলধন বিনিয়োগ করতে ভয় পাচ্ছি যে লাভ সহ ফেরত আসবে কিনা। তাই যদি হয় তাহলে এত দীর্ঘদিন যাবত কি শিক্ষা দেওয়া হলো? উৎপাদনের ছাঁচে কি ভুল ছিল, যে প্রোডাকশন মান মত হয়নি, আস্থা রাখতে পারছি না। বর্তমান সমাজ ব্যবস্থায় ষোল আনা না পেলেও আধুলি সিকিতে সমস্যা কোথায়? আমাদের টাকা’রা আমাদের বৃত্তের বাইরের প্রতিষ্ঠানের পরিচালক হতে হতে আধুলি সিকিতে পরিণত হতে পারে। হোক না, আমাদের টাকা’রা আধুলি সিকিতে রূপান্তর হলেও সময় এলে ষোল আনা হতে সময় লাগবে না। অপরদিকে আধুলি ও সিকি মানের পরিচালক কর্মকর্তা-কর্মচারীর মাধ্যমে প্রতিষ্ঠানটি একসময় আমাদের হয়ে যাবে। থাক না আমাদের বৃত্তের বাইরে কিছু আধুলি সিকি দশ পয়সা পাঁচ পয়সা। কোন একদিন হয়তো এরাই মিলেমিশে ষোল আনা হয়ে যাবে। তখন একটি ছাতার আশ্রয় হারিয়ে গেলেও আরো পাঁচটি ছাতা পাওয়ার সম্ভাবনা থাকবে, আশ্রয়হীন হওয়ার সম্ভাবনা থাকবে না। সব দায়িত্ব একজনের কাঁধে নেওয়ার কি প্রয়োজন?

‘পাছে লোকে কিছু বলে’ ভেবে সাংস্কৃতিক অঙ্গনে যথাযথ ভূমিকা পালন করতে পারছি না, এটা করা যাবে না ওটা করা যাবে না বলে বলে সব সবকিছু সংকীর্ণ, আর অন্যদিকে অপসংস্কৃতির বিভীষিকায় সয়লাব দেশমাতৃকার পবিত্র ভূমি। আমাদের সাংস্কৃতিক গোষ্ঠীগুলো বৃত্তের বাইরে যেতেই পারছে না। সমাজ সংশোধনের আগেই আদর্শিক সমাজের রীতিনীতি দ্বারা হাত-পা বেধেঁ, বস্তায় ভরে সব জায়গায় চাপিয়ে দিচ্ছি, নড়াচড়া করলে ইসলাম ডুবে যাবে, কিন্তু হিজরতের আগে মক্কায় তো ডুবেনি, সাহাবীগণ ইসলামের উপর ভর করে জাহেলিয়াতের সাগরে ভাসতেছিলেন। আমরা ভাসতে পারছিনা, একই বৃত্তের মাঝে ঘুরপাক খাচ্ছি, বৃত্তের বাইরে না গেলে সমাজ সংশোধনের প্রক্রিয়া কিভাবে শুরু হবে।

প্রচলিত সমাজ ব্যবস্থার অধীনে সার্বজনীন সংস্কৃতি কর্মকান্ডের মাধ্যমে আদর্শিক দাওয়াত দিতে হবে। যেমন দেখা যায় হুমায়ূন আহমেদের বিভিন্ন নাটক টেলিফিল্ম কিংবা সিরিয়ালে নবজাতক ও প্রসূতি মায়ের স্বাস্থ্য, শিক্ষা বিষয়ক প্রচার। এ সকল অনুষ্ঠান ভিন্ন ভিন্ন ধর্মের, ভিন্ন ভিন্ন মতের আদর্শের মানুষ উপভোগ করে এবং সাথে সাথে প্রয়োজনীয় শিক্ষাও গ্রহণ করে। এভাবেই আমাদেরকে বৃত্তের বাইরে এসে প্রচলিত সমাজের দৃষ্টিভঙ্গির আলোকে সমাজ সংশোধনের কার্যক্রম পরিচালিত করতে হবে। আদর্শিক সমাজের অনুকূলে জনমত গঠনের পরেই আদর্শিক সমাজে রীতি নীতির প্রচলন ঘটাতে হবে । দেশের আপামর জনগণের মাঝে যদি আমরা যেতেই না পারি, তাহলে ঐ মাজারপন্থিরা আমাদের ইমান আমল সর্ম্পকে জানবে কিভাবে? আমাদের লেনদেন সম্পর্কে ব্যবসায়ী মহল অবহিত না হলে, মজুদ মূলধন কি কাজে লাগবে? বাজারে বিনিয়োগ না হলে, ইমানের আলোকে রাজপথ থেকে গলি আলোকিত না হলে র্নিদিষ্ট গন্ডি থেকে বেড়িয়ে আসবেন কিভাব।

সব গাছে উঠে ফল পারা যায় না, আবার কিছু গাছে না উঠলে ফলের নাগাল পাওয়া যায়না, মহিলা কর্মীরা বাসে লঞ্চে,রেলগাড়িতে, বিমানে একা একা ভ্রমন করতে পারে, অফিস আদালতে হাটবাজারে পর পুরুষের সাথে সামনা সামনি কথা বলতে পারে,কিন্তু একই আর্দর্শিক ভাইয়ের সামনে কথা বলতে পারবে না, একত্রে বসতে পারবে না, মহিলা ভোট চাই কিন্তু মিছিল মিটিং এ যেতে পারবে না। সারা দেশে পর্দার বিধান কেউ মানে না, কিন্তু আমরা ইসলামপন্থিরা এমন ভাবে পর্দা ফরজ করে দিলাম যে চেনার উপায় নেই, নাক মুখ ঢেকে অবরোধবাসীনি বানিয়ে দিলাম। আমাদের বোনেরা সমাজ থেকে আলাদা হয়ে গেল। একত্রে চলাফেরা কষ্টসাধ্য হলো, যতটুকু ছাড় ছিল সেটাও কঠিন করে লাভের চেয়ে ক্ষতির পরিমান বেড়ে চললো। এমন আরও অনেক সহজ বিষয়কে কঠিন থেকে কঠিনতর করে নিজেদের চলার পথ সংকির্ন্য করে ফেলেছি।

এসব বিষয় চিন্তা করে কর্মপদ্ধতি সংশোধন করতে হবে,না হলে ঘোড়ার আগে গাড়ি জুড়ে দেওয়ার মতো অরণ্যে রোদন হবে বৈকি।

এই প্রকাশনাটি শেয়ার করুন:

Picture of ইবনে শাহ

ইবনে শাহ

ইসলামী চিন্তাবিদ

সম্পর্কিত প্রকাশনাসমূহ

দেশপ্রেমের হাকিকত!!!

দেশ প্রেম নিয়ে আমাদের দেশে ৫০ বছরের বেশি সময় ধরে আলোচনা-সমালোচনার ঝড় বয়ে চলছে। সেই ১৯৭১ সাল থেকে শুরু করে অদ্যবধি পর্যন্ত এদেশের রাজনৈতিক ময়দান গরম করা, দৃষ্টি আকর্ষণ

আরও পড়ুন »

তুমি অধম বলিয়া আমি উত্তম হইব না কেন?

হেফাজতে ইসলামের আমীর আল্লামা শাহ আহমদ শফী রহমাতুল্লাহ আলাইহির মৃত্যুর পরেরদিন থেকে দেশের এবং আন্তর্জাতিক মিডিয়া জগতে বিশেষ করে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে একটি ছবি এবং খবর খুবই ভাইরাল হয়েছে

আরও পড়ুন »

ঈমানী নিশান

সর্বাধিক প্রাক্তন মধ্যে. গ্র্যাভিডা ফ্রিঙ্গিলা লেকটাসে, ভেল কনভালিস ডলোর ট্রিস্টিক নন। খুব ভালো লাগে। ফুসস কনগেইস্ট বা কনগে গ্র্যাভিডা। আলিকুম ইরাত ভলুটপাট। মৌরিস দাপিবাস অ্যালিকুয়েট আগে নেক সাগিটিস। সর্বাধিক

আরও পড়ুন »

ইসলাম বিরোধী ষড়যন্ত্র বাস্তবায়নে মুসলমান

অতিসম্প্রতি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে দেখা যায় বিভিন্ন ইসলামী বক্তা ওয়াজের ময়দানে একে অপরকে তুলাধুনা ধরেছে। শরীয়তের নির্ধারিত ফরজ ওয়াজিব বিষয় নিয়ে এসব বিতর্ক হয় না। বিতর্ক ও মতবিরোধ হচ্ছে

আরও পড়ুন »

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

ইবনে ই শাহ ব্লগগুলি বাংলাদেশের লক্ষ লক্ষ মানুষের জন্য তথ্যের একটি অত্যাবশ্যক উৎস হয়ে উঠেছে, যা জাতীয় ও আন্তর্জাতিক সংবাদ, রাজনীতি, খেলাধুলা, বিনোদন এবং আরও অনেক কিছুর রিয়েল-টাইম আপডেট প্রদান করে।